হেভি মেটাল ব্যান্ডের ড্রামার থেকে জাপানে ইতিহাস গড়ে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী; কে এই সানায়ে তাকাইচি?

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে আদর্শ মানতেন তিনি। আর মনে মনে লালন করতেন জাপানের 'আইরন লেডি' হওয়ার স্বপ্ন।
দুটি ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে সেই বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো সানায়ে তাকাইচির। গত ২১ অক্টোবর এক ঐতিহাসিক সংসদীয় ভোটে ৬৪ বছর বয়সী এই রাজনীতিক জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছেন।
দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে তাকে একদিকে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)-কে নেতৃত্ব দিতে হবে, যা কেলেঙ্কারির জেরে ভোটারদের আস্থা ফেরাতে ধুঁকছে এবং উগ্র ডানপন্থীদের মাথাচাড়া দেওয়া মোকাবিলা করছে। অন্যদিকে, নেতৃত্ব দিতে হবে এমন একটি দেশকে, যা মন্থর অর্থনীতি, নিম্ন জন্মহার এবং ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মতো বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
১৯৬১ সালে নারা প্রদেশে তাকাইচির জন্ম। বাবা ছিলেন অফিস কর্মী, আর মা পুলিশ কর্মকর্তা। রাজনীতি থেকে অনেক দূরে ছিল তার বেড়ে ওঠা। তাকাইচি ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র। একসময় হেভি মেটাল ব্যান্ডের ড্রামার হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। তীব্র পারফরম্যান্সের কারণে ড্রামস্টিক ভেঙে ফেলতেন বলে তিনি অনেক ড্রামস্টিক বহন করতেন।
সাংবাদিকদের তিনি জানান, এখনও তিনি আইরন মেইডেন এবং ডিপ পার্পলের মতো হেভি মেটাল ব্যান্ডের অনুরাগী এবং তার বাড়িতে একটি ইলেকট্রিক ড্রাম কিট রয়েছে। শুধু তাই নয়, তাকাইচি একজন স্কুবা ডাইভার এবং গাড়িপ্রেমীও ছিলেন; তার প্রিয় টয়োটা সুপ্রা গাড়িটি এখন নারা জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
রাজনীতিতে আসার আগে তাকাইচি স্বল্প সময়ের জন্য টেলিভিশন সঞ্চালিকা হিসেবে কাজ করেছেন। ৮০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-জাপান বাণিজ্য বিরোধ যখন তুঙ্গে, তখন আসে তার রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা। জাপানের বিষয়ে আমেরিকানদের ধারণা বুঝতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে তিনি ডেমোক্র্যাট প্যাট্রিসিয়া শ্রোয়েডারের অফিসে কাজ করেন।
সেখানে তিনি লক্ষ্য করেন, আমেরিকানরা কীভাবে জাপানি, চীনা এবং কোরিয়ান ভাষা ও খাবারকে গুলিয়ে ফেলছে এবং কীভাবে জাপানকে প্রায়শই চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে এক করে দেখা হয়। এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান, 'জাপান যদি নিজেকে রক্ষা করতে না পারে, তবে তার ভাগ্য সবসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগভীর মতামতের করুণার ওপর নির্ভরশীল থাকবে।'

১৯৯২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রথম সংসদীয় নির্বাচনে হেরে গেলেও হাল ছাড়েননি তাকাইচি। এক বছর পরই একটি আসন জিতে নেন এবং ১৯৯৬ সালে এলডিপি-তে যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে ১০ বার নির্বাচিত হয়েছেন, মাত্র একবার হেরেছেন। দলের অন্যতম স্পষ্টভাষী রক্ষণশীল কণ্ঠস্বর হিসেবে তিনি দ্রুত খ্যাতি অর্জন করেন। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা মন্ত্রী, বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবং অভ্যন্তরীণ ও যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে রেকর্ড সংখ্যক বার দায়িত্ব পালনসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন ছিলেন তিনি।
২০২১ সালে তাকাইচি ফুমিও কিশিদার কাছে হেরে যান। ২০২৪ সালে তিনি আবারও চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত শিগিরু ইশিবার কাছে পরাজিত হন। এই বছর, তার তৃতীয় প্রচেষ্টায় মিললো সফলতা। সংসদ কর্তৃক নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস গড়লেন। সম্প্রতি তার প্রচারণার সময় একদল স্কুলশিক্ষার্থীকে তিনি বলেছিলেন, 'আমার লক্ষ্য হলো আইরন লেডি হওয়া।'
তাকাইচি একজন কট্টর রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিবাহিত নারীদের বিয়ের পর নিজেদের কুমারী নাম বজায় রাখার অনুমতি দেওয়ার আইনের বিরোধিতা করে এসেছেন, কারণ তার মতে এটি ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ন করে। তিনি সমলিঙ্গের বিবাহেরও বিরোধী।
তবে, সাম্প্রতিক সময়ে তার সুরে কিছুটা নরম হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বেবিসিটার ফি আংশিকভাবে করমুক্ত করার এবং যেসব কোম্পানি অভ্যন্তরীণ শিশু পরিচর্যা পরিষেবা দেবে, তাদের জন্য কর্পোরেট কর ছাড়ের প্রস্তাব করেছেন। তার পরিবার এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তার নীতি প্রস্তাবনার ভিত্তি তৈরি করেছে: নারীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল পরিষেবা বৃদ্ধি, গৃহস্থালি সহায়তাকর্মীদের আরও বেশি স্বীকৃতি দেওয়া এবং জাপানের ক্রমবর্ধমান বয়স্ক সমাজের জন্য যত্নের বিকল্পগুলি উন্নত করা।
প্রয়াত শিনজো আবের একজন অনুসারী হিসেবে, তিনি তার 'আবেনোমিক্স' অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছেন, যেখানে উচ্চ সরকারি ব্যয় এবং সস্তা ঋণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি তার অন্য আদর্শ ব্যারনেস থ্যাচারের সম্পূর্ণ বিপরীত, কারণ ব্রিটেনের প্রয়াত এই নেত্রী উচ্চ সরকারি ব্যয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন বলে সুপরিচিত।
আবের মতোই তাকাইচিকে পররাষ্ট্রনীতিতে কট্টরপন্থী হিসেবে দেখা হয়। তিনি বিতর্কিত ইয়াসুকুনি মন্দিরের নিয়মিত পরিদর্শক, যেখানে জাপানের যুদ্ধাহতদের, যার মধ্যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্তরাও আছেন, সম্মান জানানো হয়। তিনি দেশের আত্মরক্ষা বাহিনীর সাংবিধানিক বিধিনিষেধ শিথিল করারও আহ্বান জানিয়েছেন, যাদের আক্রমণাত্মক সক্ষমতা রাখা নিষিদ্ধ।
১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলডিপি জাপানের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে, কিন্তু অর্থনীতি নিয়ে হতাশা, জনসংখ্যা হ্রাস এবং সামাজিক অসন্তোষের কারণে দলটি এখন জনসমর্থন হারাচ্ছে। 'জাপান ফার্স্ট' স্লোগানে পরিচালিত কট্টর ডানপন্থী সানসেইতো পার্টি সম্প্রতি ১টি আসন থেকে ১৫টি আসনে উন্নীত হয়েছে, যা রক্ষণশীল ভোটারদের এলডিপি থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে এলডিপি সংসদের উভয় কক্ষেই তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।
তাকাইচিকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে এলডিপি আশা করছে, তারা কট্টর ডানপন্থী সানসেইতো পার্টির দিকে ঝুঁকে যাওয়া রক্ষণশীল ভোটারদের ফিরিয়ে আনতে পারবে।
প্রথম দফার ভোটে জয়লাভের পর এক বক্তৃতায় তাকাইচি নিজেও এই সমস্যার কথা স্বীকার করেছিলেন: 'আমরা আমাদের মূল সমর্থক, রক্ষণশীল এবং দলীয় সদস্যদের কাছ থেকে বিশেষত কঠোর সমালোচনা পেয়েছি। জাপানের বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বার্থে এলডিপি-কে অবশ্যই পরিবর্তন হতে হবে। আমরা সর্বদা জাতীয় স্বার্থকে প্রথমে রাখব এবং ভারসাম্যপূর্ণভাবে দেশ পরিচালনা করব।'
ড্রামার থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা সানায়ে তাকাইচি এখন জাপানের রাজনৈতিক মঞ্চে এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছেন। তাকে মোকাবিলা করতে হবে বহু চ্যালেঞ্জ, কিন্তু তার দৃঢ়তা এবং 'আইরন লেডি' হওয়ার স্বপ্ন জাপানের ভবিষ্যৎ কোন দিকে নিয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।