সংকটে পুরো এক প্রজন্ম: তরুণরা কেন এত অসুখী?
আজকের তরুণ প্রজন্ম এক গভীর সংকটে। তাদের ঘিরে ধরেছে বিষণ্ণতা আর হতাশার কালো মেঘ। একাকীত্ব গ্রাস করছে, বেকারত্ব তাড়া করছে, নিজের একটা বাড়ি কেনার স্বপ্নটাও যেন মরীচিকা। কিন্তু এর চেয়েও বড় ধাক্কা হলো, মাত্র কয়েক বছর আগেও কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি যে তাদের এমন এক পরিস্থিতির শিকার হতে হবে।
আগস্ট মাসে মার্কিন বৈজ্ঞানিক জার্নাল 'প্লস ওয়ান'-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ যেন এই সংকটেরই প্রতিচ্ছবি। সেখানে বলা হয়েছে, আজকের দুনিয়ায় তরুণদের চেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট আর কোনো বয়সের মানুষ নেই। আগে সুখের গ্রাফটা ছিল বেশ সোজা-সাপ্টা: শৈশব আর যৌবনে মানুষ থাকত হাসিখুশি, মাঝবয়সে এসে চাপ বাড়ত, আর বৃদ্ধ বয়সে আবার সুখ ফিরে আসত।
কিন্তু এখন সেই হিসাবটাই পুরোপুরি ওলটপালট হয়ে গেছে। তরুণরাই একমাত্র গোষ্ঠী, যাদের সুখের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১২ থেকে ২৪ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীরা। এই গবেষণাটি ৪০টিরও বেশি দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর করা সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি।
আজকের তরুণ প্রজন্মকে প্রায়ই 'স্নোফ্লেক জেনারেশন' বা অতিরিক্ত সংবেদনশীল বলে আখ্যা দেওয়া হয়। তারা তাদের বাবা-মা বা দাদা-দাদির চেয়ে অনেক বেশি মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যায় এবং ওসিডি, এডিএইচডি, বার্নআউট-এর মতো শব্দগুলো খুব সহজেই ব্যবহার করে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে এই বাড়তি সচেতনতা কি তাদের সামগ্রিক মেজাজকে খারাপ করে দিয়েছে? কোপেনহেগেনের হ্যাপিনেস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক আলেজান্দ্রো সেনসেরাদো বলেন, "অগত্যা নয়, তবে এটা স্পষ্ট যে ২০ বছর বয়সী একজনের কাছে সুখের অর্থ তার দাদির কাছে যা ছিল, তার থেকে অনেকটাই আলাদা।"
পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। একসময় ভালো স্মৃতিশক্তিকে বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ বলে মনে করা হতো, কিন্তু আজকের দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সেই গুণ আর তেমন কাজে আসে না। একইভাবে, ৫০ বছর আগে সুখের সংজ্ঞা ছিল একটি প্রথাগত পরিবার বা ঈশ্বরের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক, যা এখনকার ভালো থাকার ধারণা থেকে ভিন্ন।
তবে এটা শুধু অনুভূতির কথা নয়, কঠিন পরিসংখ্যানও একই ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ২০০৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ৭০% বেড়েছে! ইউরোপীয় ইউনিয়নেও একই ধরনের বৃদ্ধি দেখা গেছে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি এবং মানসিক রোগের ওষুধের ব্যবহারও এখন আকাশছোঁয়া।
'প্লস ওয়ান' রিপোর্ট অনুযায়ী, তরুণদের অসুখী হওয়ার এই প্রবণতা ২০১২ সালের দিকে হঠাৎ করেই তীব্রভাবে বাড়তে শুরু করে। তখন এমন কী ঘটেছিল, যার বিশ্বব্যাপী প্রভাব আজও এত গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে?
প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ভিলেন হিসেবে দায়ী করা হয় সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্মার্টফোনের উত্থানকে। সমাজবিজ্ঞানী জোনাথন হাইডট বলেন, এই প্রযুক্তিগুলো যে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে, তা অস্বীকার করার আর কোনো উপায় নেই। তিনি সোজাসাপ্টা ভাষায় বলেন, "সোশ্যাল মিডিয়া হতাশা এবং উদ্বেগের একটি প্রধান কারণ—এবং এটি কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়।"
হাইডট আরও বলেন, সমস্যাটা শুধু ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মের কারণে তৈরি হওয়া একাকীত্ব বা উদ্বেগেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং, এই নেটওয়ার্কগুলো তরুণদের একে অপরের সাথে মেশার পুরো ধরণটাই ওলটপালট করে দিয়েছে। এমনকি ঘুমের মতো একটি অপরিহার্য বিষয়ও স্মার্টফোনের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঘুম বিশেষজ্ঞ ড. জাভিয়ের আলবারেস সতর্ক করে বলেন, ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার একটি "প্রজন্মকে অতিরিক্ত উত্তেজনা, আসক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী ঘুমের অভাবের এক ভয়ংকর চক্রে আটকে ফেলছে।"
তবে শুধু প্রযুক্তিই একমাত্র খলনায়ক নয়। হাইডট আরও একটি অদ্ভুত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কারণের দিকে আঙুল তুলেছেন যেমন "বাস্তব জগতে শিশুদের অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়া।" আজকের শিশুরা বাইরে একা খেলার স্বাধীনতা হারিয়েছে। একসময় তারা দল বেঁধে, কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে খেলত, যা তাদের সহনশীলতা এবং স্বাবলম্বী হতে শেখাত। তিনি এটিকে খুব সুন্দরভাবে এক লাইনে বলেছেন: আজ বাস্তব জগতে শিশুরা কাঁচের ঘরে বড় হচ্ছে, আর ভার্চুয়াল জগতে তাদের জন্য কোনো সুরক্ষাই নেই।
এই পরিস্থিতির সাথে যোগ হয়েছে আরেকটি বড় সংকট। দার্শনিক জেসুস জি. মায়েস্ত্রো তরুণদের এই অসুস্থতার জন্য দায়ী করেছেন তাদের বাবা-মায়ের । তিনি বলেন, "এটি এমন এক প্রজন্ম, যাদের সবকিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুই পায়নি।"
মায়েস্ত্রোর মতে, বেবি বুমার প্রজন্ম তাদের সন্তানদের এমন এক পৃথিবীর জন্য বড় করেছে, যার আর কোনো অস্তিত্বই নেই। তিনি এই প্রজন্মের প্রতি কঠোর সমালোচনার নিন্দা করে বলেন: "তরুণদের সম্পর্কে না জেনেই খুব খারাপ কথা বলা হয়। তাদের অলস, বোকা বা অকেজো বলে আক্রমণ করা হয়।"
অনেক তরুণ এই স্বপ্ন চোখে নিয়ে বড় হয়েছে যে, তাদের জীবন বাবা-মায়ের চেয়েও ভালো হবে, সুযোগে ভরপুর থাকবে। কিন্তু আজকের উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী তরুণদের জন্য বাস্তবতা ভীষণ কঠিন। আজকের তরুণদের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক খারাপ।
সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিসিয়া কাস্ত্রো বলেন, "তরুণদের মধ্যে এক ধরনের গভীর হতাশা কাজ করছে। আমাদের বাবা-মায়ের প্রজন্ম, এমনকি যদি তারা দারিদ্র্য থেকেও উঠে এসে থাকে, তাদের জীবনে এগিয়ে যাওয়ার একটি আশা ছিল। সেটাই এখন অনেকাংশে হারিয়ে গেছে।"
বিশেষজ্ঞরা এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখা দেখাতে বেশ কিছু সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার দরজা সবার জন্য খুলে দেওয়া।
জোনাথন হাইডট ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশাধিকার না দেওয়ার মতো পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। আর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি—বিশেষ করে ভালো চাকরি এবং সাধ্যের মধ্যে বাসস্থানের সুযোগ বাড়ানো—অবশ্যই এই ক্ষত সারাতে সাহায্য করবে।
প্যাট্রিসিয়া কাস্ত্রোর মতে, মূল চাবিকাঠি হলো সামাজিক বন্ধনকে আরও মজবুত করা, একে অপরের পাশে দাঁড়ানো।
আর জেসুস জি. মায়েস্ত্রো, তার সাহিত্য অধ্যাপকের পরিচয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে, এক অভিনব কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের প্রস্তাব দিয়েছেন: "ডন কিহোতে পড়ুন। যদি কিছু শেখার থাকে, তবে তা হলো আকাশছোঁয়া স্বপ্ন প্রায়শই ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যায়।"
এবং তিনি এক কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন: "যদি আপনি তরুণদের যত্ন না নেন, তবে আপনি আসলে সমাজের ভবিষ্যৎকেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন।"
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা
