নতুন ‘পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা' নিয়ে আসছে চীন; অতীতের পরিকল্পনাগুলো যেভাবে বদলে দিয়েছিল বিশ্বকে

চীনের শীর্ষ নেতারা এই সপ্তাহে বেইজিংয়ে জমায়েত হচ্ছেন দেশটির আগামী দশকের মূল লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা নির্ধারণের জন্য। খবর বিবিসি'র।
প্রায় প্রতি বছর দেশটির সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংস্থা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এক সপ্তাহব্যাপী বৈঠকের আয়োজন করে, যাকে প্লেনামও বলা হয়। এই বৈঠকে যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা পরবর্তীতে চীনের পরবর্তী 'পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা'–এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি তার নীতি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করবে।
সম্পূর্ণ পরিকল্পনা আগামী বছর প্রকাশিত হবে, তবে কর্মকর্তারা সম্ভবত বুধবার এর সংক্ষিপ্ত তথ্য প্রকাশ করবেন। অতীতেও তারা বৈঠকের এক সপ্তাহের মধ্যে বিস্তারিত জানানোর রীতি পালন করেছেন।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের চীনা রাজনীতি বিষয়ক ফেলো নীল থমাস বলেন, 'পশ্চিমা নীতি নির্বাচনী চক্রের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু চীনের নীতি প্রণয়ন পরিকল্পনা চক্রের ওপর ভিত্তি করে চলে।'
তিনি আরও বলেন, 'পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চীনের অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে, নেতৃত্ব কোন দিকে যেতে চায় তা নির্দেশ করে এবং রাষ্ট্রের সম্পদকে এই পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করে।'
সরাসরি দেখলে শতাধিক স্যুট পরা সরকারি কর্মকর্তার হাত মেলানো ও পরিকল্পনা তৈরি করার দৃশ্য আকর্ষণীয় নাও মনে হতে পারে। তবে ইতিহাস বলছে, তাদের সিদ্ধান্ত প্রায়ই বিশ্বের ওপর বড় প্রভাব ফেলে।
চীনের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বিশ্ব অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করেছে এমন তিনটি উদাহরণ হলো:
১৯৮১-৮৪: 'সংশোধন ও উদারীকরণ'
চীন কখন অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার পথে পা বাড়ালো তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে পার্টির অনেকেই বলেন, এটি শুরু হয় ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে।
প্রায় তিন দশক ধরে চীনের অর্থনীতি রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে সোভিয়েত ধাঁচের কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে ব্যর্থ হয় এবং অনেক মানুষ তখনও দারিদ্র্যে ভোগেন।
দেশটি এখনও মাও সেতুং-এর শাসনের পর পুনরুদ্ধারের পথে ছিল। 'মহা উন্নয়ন অভিযান' এবং 'সাংস্কৃতিক বিপ্লব'-এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও সমাজ পুনর্গঠনের জন্য বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন মাও। তবে এতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুও হয়েছিল।
বেইজিংয়ে ১১তম কমিটির তৃতীয় প্লেনামে ভাষণ দেন দেশের নতুন নেতা ডেং জিয়াওপিং। তিনি ঘোষণা দেন, কিছু পরিমাণে মুক্ত বাজারের উপাদান গ্রহণের সময় এসেছে।
তার 'সংশোধন ও উদারীকরণ' নীতি পরবর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পচর মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে, যা ১৯৮১ সালে শুরু হয়। মুক্ত বাণিজ্যের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন এবং সেগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগের আগমন চীনের মানুষের জীবন পরিবর্তন করে দেয়।
থমাসের মতে, সেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো সবচেয়ে স্পষ্টভাবে অর্জিত হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আজকের চীন ১৯৭০-এর দশকের মানুষের সবচেয়ে উগ্র কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় গৌরব পুনঃস্থাপন এবং বিশ্বের মহাশক্তির মধ্যে নিজের স্থান প্রতিষ্ঠার দিক থেকে তা অসাধারণ।'
কিন্তু এই পরিকল্পনা বিশ্ব অর্থনীতিকেও মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছে। একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের লাখ লাখ উৎপাদননির্ভর চাকরি চীনের উপকূলীয় অঞ্চলের নতুন কারখানায় চলে আসে।
অর্থনীতিবিদরা এটিকে 'চায়না শক' নামে অভিহিত করেছেন। এটি ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক শিল্পাঞ্চলগুলোতে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের উত্থানের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি—তার শুল্ক এবং বাণিজ্য যুদ্ধ—প্রায় আগের কয়েক দশকে চীনের কাছে হারানো মার্কিন উৎপাদনশীল চাকরি ফিরিয়ে আনার জন্য পরিকল্পিত।
২০১১-১৫: 'কৌশলগত উদীয়মান শিল্প'
চীন যখন ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগ দেয়, তখন বিশ্ব কর্মশালা হিসেবে দেশটির অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়। তবে শতাব্দীর শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ইতোমধ্যেই পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা আঁকছিল।
তারা উদ্বিগ্ন ছিল চীনের 'মধ্যম আয়ের ফাঁদে' পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে। অর্থাৎ দেশটি আর খুব কম মজুরি দিতে পারবে না, কিন্তু উচ্চমানের পণ্য ও সেবা তৈরি করার উদ্ভাবনী ক্ষমতাও অর্জন করতে পারেনি।
সুতরাং শুধু সস্তা উৎপাদনের পরিবর্তে চীনের প্রয়োজন ছিল যা তারা 'কৌশলগত উদীয়মান শিল্প' বলে ডাকত। এটি প্রথমবার সরকারিভাবে ২০১০ সালে ব্যবহৃত হয়। চীনের নেতাদের জন্য এর মানে ছিল পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, যেমন বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) এবং সৌর প্যানেল।
পশ্চিমা রাজনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চীনের পক্ষ থেকে এই নতুন শিল্পে অভূতপূর্ব পরিমাণে সম্পদ বিনিয়োগ করা হয়।
আজকের চীন শুধু নবায়নযোগ্য শক্তি ও বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) খাতে বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বীই নয়, এগুলো তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বিরল খনিজের সরবরাহ শৃঙ্খলেও প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে।
চীনের এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে নিয়ন্ত্রণ—যা চিপ উৎপাদন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-এর জন্যও অপরিহার্য—বিশ্বব্যাপী দেশটিকে শক্তিশালী অবস্থানে রাখে। এই অবস্থান এতই শক্তিশালী যে, সম্প্রতি চীনের বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ কঠোর করার পদক্ষেপকে ট্রাম্প 'বিশ্বকে বন্দি করার চেষ্টা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
যদিও 'কৌশলগত উদীয়মান শিল্প' ২০১১ সালের পরবর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিকে বৃদ্ধি ও ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্ভাব্য চালক হিসেবে চীনের তখনকার নেতা হু জিনতাও ২০০০-এর দশকের শুরুতে সনাক্ত করেছিলেন।
নীল থমাস ব্যাখ্যা করেন, 'চীনের অর্থনীতি, প্রযুক্তি এবং কার্যকলাপে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা অনেক দিনের—এটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তাধারার অংশ।'
২০২১-২০২৫: 'উচ্চ পর্যায়ের উন্নয়ন'
এই কারণেই সম্প্রতি চীনের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় 'উচ্চ পর্যায়ের উন্নয়ন'-এর দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭ সালে শি জিনপিং পরিচয় করান।
এর মানে হলো প্রযুক্তিতে মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা এবং চীনের এই খাতে অগ্রণী অবস্থান নিশ্চিত করা।
ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক, টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট হুয়াওয়ে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেল ডিপসীক—সবই এই শতাব্দীতে চীনের প্রযুক্তিগত উত্থানের প্রমাণ।
কিন্তু পশ্চিমা দেশ বারবার এটিকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। এর ফলে জনপ্রিয় চীনা প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা বিশ্বের কোটি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে প্রভাবিত করেছে এবং তীব্র কূটনৈতিক বিবাদ সৃষ্টি করেছে।
এ পর্যন্ত চীন তার প্রযুক্তিগত সাফল্য অর্জন করেছে আমেরিকান উদ্ভাবনের ওপর নির্ভর করে, যেমন এনভিডিয়ার উন্নত সেমিকন্ডাক্টর।
কিন্তু ওয়াশিংটন এখন চীনের কাছে এ ধরনের পণ্যের বিক্রি বন্ধ করায় আশা করা যায়, 'উচ্চ মানের উন্নয়ন' ধীরে ধীরে 'নতুন মানের উৎপাদনশীল শক্তি'-তে রূপান্তরিত হবে। এটি ২০২৩ সালে শি জিনপিং পরিচয় করানো নতুন স্লোগান, যা আরও বেশি করে দেশীয় গৌরব ও জাতীয় নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দেয়।
এর মানে চীন চিপ উৎপাদন, কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে নিজেকে সর্বাধুনিক অবস্থানে নিয়ে যাবে, পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকবে না এবং নিষেধাজ্ঞার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে।
সকল ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা, বিশেষ করে সর্বোচ্চ স্তরের উদ্ভাবনে, পরবর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কেন্দ্রীয় নীতি হতে পারে।
নীল থমাস ব্যাখ্যা করেন, 'জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা এখন চীনের অর্থনৈতিক নীতির মূল লক্ষ্য। আবারও বলা যায়, এটি সেই জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের অংশ, যা চীনা কমিউনিজমকে সমর্থন করে, যাতে চীন আর কখনো বিদেশি দেশগুলোর আধিপত্যের কবলে না থাকে।