চীনে শূকরের যকৃত প্রতিস্থাপনের পর ১৭০ দিনের বেশি বেঁচে ছিলেন যিনি

চীনের চিকিৎসকরা এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা জিনগতভাবে পরিবর্তিত একটি শূকরের যকৃত (লিভার) ৭১ বছর বয়সী এক ব্যক্তির দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেন। প্রতিস্থাপনের পর ওই ব্যক্তি মোট ১৭১ দিন বেঁচে ছিলেন, যার মধ্যে ৩৮ দিন তিনি শূকরের যকৃতটি নিয়েই স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন। এধরণের কোন ঘটনা বিশ্বের প্রথম কোনো স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা এর আগে জিনগতভাবে পরিবর্তিত শূকরের কিডনি এবং হৃৎপিণ্ড মানুষের দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেছেন। এমনকি ব্রেন-ডেড বা মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটেছে এমন ব্যক্তির দেহেও শূকরের যকৃত প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু জেনোট্রান্সপ্ল্যান্টেশন অর্থাৎ পশু থেকে মানবদেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা যকৃতকে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অঙ্গ হিসেবেই দেখতেন।
চীনের আনহুই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হসপিটালের প্রেসিডেন্ট এবং এই গবেষণার সহ-লেখক ড. বেইচেং সান বলেন, 'সবাই বলতেন হৃৎপিণ্ড বা কিডনির তুলনায় যকৃত প্রতিস্থাপন অনেক বেশি জটিল। কিন্তু আমি মনে করি, এই সাফল্যের পর মানুষের ধারণা বদলে যাবে। আমরা যদি শূকরের ডিএনএ-তে যথেষ্ট পরিমাণে জিন প্রবেশ করাতে পারি, তবে যকৃত প্রতিস্থাপন একটি দারুণ সম্ভাবনা তৈরি করবে।'
হৃৎপিণ্ড বা কিডনির কাজ তুলনামূলকভাবে নির্দিষ্ট হলেও, যকৃতের গঠন ও কাজ অনেক বেশি জটিল। এটি রক্ত পরিশোধন করে, শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে, পুষ্টি প্রক্রিয়াজাত করে, হজমে সাহায্য করার জন্য পিত্তরস তৈরি করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রোটিন তৈরি করে। এর বহুমুখী কাজের কারণেই শূকরের যকৃত দিয়ে মানুষের যকৃতের কাজ চালানো কঠিন বলে মনে করা হতো।
কেন এই প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়েছিল?
এই গবেষণাপত্রে যে ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, তিনি হেপাটাইটিস বি-জনিত সিরোসিসে আক্রান্ত ছিলেন। তার যকৃতের ডান অংশে একটি বড় টিউমারও ছিল। চিকিৎসকরা যখন তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যকৃত দাতা হিসেবে কাউকে পাননি, তখন তার জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায় হিসেবে জিন-সম্পাদিত শূকরের যকৃত প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অস্ত্রোপচার এবং তার ফলাফল
২০২৪ সালের মে মাসে চিকিৎসকরা ১১ মাস বয়সী একটি শূকরের যকৃত ওই ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করেন। শূকরটির ডিএনএ-তে ১০টি জিনগত পরিবর্তন আনা হয়েছিল, যাতে মানবদেহ অঙ্গটিকে প্রত্যাখ্যান না করে।
প্রতিস্থাপনটি প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছিল। শূকরের যকৃতটি শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করে দেয় এবং পিত্তরস তৈরি করতে থাকে। প্রথম ১০ দিনের মধ্যে অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বরং, ব্যক্তির নিজের যকৃতের অবশিষ্ট অংশ আগের চেয়ে ভালোভাবে কাজ করতে শুরু করে।
কিন্তু ২৫ দিনের মাথায় রোগীর হৃৎপিণ্ডে সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে রক্তনালীতে ক্ষুদ্র রক্ত জমাট বেঁধে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো জটিলতা তৈরি হয়। ৩৭ দিনের মাথায় তার রক্তচাপ মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং তিনি চেতনা হারাতে থাকেন। তখন চিকিৎসকরা দেখেন, তার নিজের যকৃত সেরে উঠে শরীরকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাই ৩৮ দিনের মাথায় শূকরের যকৃতটি সরিয়ে ফেলা হয়। এরপরও তিনি নিজের যকৃত নিয়েই সুস্থভাবে বেঁচে ছিলেন।
প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার ১৭১ দিনের মাথায় গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তক্ষরণের কারণে তিনি মারা যান।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য এর তাৎপর্য কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গবেষণা প্রমাণ করে যে শূকর থেকে মানবদেহে যকৃত প্রতিস্থাপন একটি 'সেতু' বা 'ব্রিজ' হিসেবে কাজ করতে পারে। এর মাধ্যমে গুরুতর অসুস্থ কোনো রোগীকে ততদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, যতদিন না তার নিজের যকৃত সেরে ওঠে অথবা কোনো যকৃত দাতা পাওয়া যায়।
জার্মানির হ্যানোভার মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক ড. হেইনার ওয়েডেমেয়ার এই গবেষণাকে 'সতর্ক আশাবাদের কারণ' হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, 'এটি সত্যিই যুগান্তকারী। একজন যকৃত প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ হিসেবে এটি আমার সামনে সম্পূর্ণ নতুন একটি দিগন্ত খুলে দিয়েছে। শূকরের যকৃত আমাদের রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে এবং এটি সত্যিই আশাব্যঞ্জক।'
শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই এক লক্ষের বেশি মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষা করছেন, যার মধ্যে ৯ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রয়োজন যকৃত। মানুষের অঙ্গের এই বিশাল চাহিদা মেটাতে শূকরের অঙ্গ প্রতিস্থাপন ভবিষ্যতে লাখো মানুষের জীবন বাঁচানোর চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে।