জলাভূমির ‘ভূতুরে’ আলেয়ার নতুন রহস্যভেদ বিজ্ঞানীদের
কেউ একে বলেন উইল-ও'-দ্য-উইস্পস, আবার কেউ বলেন ইগনিস ফাতুয়াস। লাতিন শব্দ ইগনিস ফাতুয়াস এর অর্থ 'বোকা আগুন'। বাংলায় একে বলা হয় 'আলেয়া'।
নাম যাই হোক, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ জলাভূমি, দোয়াঁশ ও অন্যান্য আর্দ্র ভূমিতে ভেসে থাকা অদ্ভুত নীলচে শিখার মতো আলো দেখার কথা জানিয়েছেন।
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এসব ক্ষণস্থায়ী অস্বাভাবিকতাকে পরী, ভূত কিংবা আত্মা হিসেবে ব্যাখা করা হতো।
তবে বিজ্ঞানীরা এর আলাদা ব্যাখ্যা দিয়েছেন: পচনশীল পদার্থ থেকে নির্গত মিথেনসহ অন্যান্য গ্যাস অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সাময়িকভাবে দপ করে জ্বলে ওঠে, তখনই এ ধরনের আলোকচ্ছটা তৈরি হয়।
তবু বিজ্ঞানীদের কাছে একটি প্রশ্ন দীর্ঘদিন অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যেহেতু এসব আলো আসল আগুন নয় এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ঘটে, তবুও এগুলোকে কোনোভাবে জ্বলে উঠতে হয়। কিন্তু সেই 'ইগনিশন' বা প্রজ্জ্বলনের উৎস কী—তা এতদিন অজানা ছিল।
প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস ইউএসএ-তে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ বিষয়ে কিছু অজানা তথ্য মিলেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, এর কারণ হলো মাইক্রোলাইটনিং বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ। জলকণার পৃষ্ঠে চার্জের পার্থক্যের কারণে এসব স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়।
অর্থাৎ, পানির ক্ষুদ্র ফোঁটার উপর ভিন্ন ভিন্ন বৈদ্যুতিক চার্জ জমে এটি ঘটে। এক ফোঁটার গায়ে ধনাত্মক চার্জ আরেকটির গায়ে ঋণাত্মক চার্জ থাকলে, তারা কাছাকাছি এলে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। সেই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গকেই বলা হয় মাইক্রোলাইটনিং বা ক্ষুদ্র বজ্রপাত।
জলাভূমির নিচ থেকে মিথেনবাহী বুদবুদ উপরে উঠে ফেটে গেলে ক্ষুদ্র জলকণা তৈরি হয় এবং এর ফলে চার্জ পার্থক্যজনিত স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়, যা মিথেনকে প্রজ্জ্বলিত করে আলো ছড়ায়।
গবেষণার প্রধান লেখক স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থরসায়নবিদ রিচার্ড জারে বলেন, 'প্রথম শুনলে মনে হতে পারে, আচ্ছা ভূতুড়ে আলো তো কী হয়েছে? কিন্তু আমরা খুঁজে পেয়েছি রাসায়নিক বিক্রিয়াকে কীভাবে ইন্টারফেসে চালিত করা যায়। এটা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।'
পানি সাধারণত নিরপেক্ষ, অর্থাৎ এর কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ থাকে না। তবে ১৮৯২ সালেই বিজ্ঞানীরা জানান, বাতাসে ক্ষুদ্র জলকণা যেমন জলপ্রপাতের ফোঁটা বা কুয়াশায় ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জ বহন করতে পারে।
জারে ও তার সহকর্মীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন, বিপরীত চার্জযুক্ত দুটি ক্ষুদ্র জলকণা কাছাকাছি এলে হঠাৎ বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি হতে পারে, যা মাইক্রোলাইটনিং সৃষ্টি করে।
তারা চলতি বছরের মার্চে সায়েন্স অ্যাডভান্সেস-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় প্রথম 'মাইক্রোলাইটনিং' শব্দটির প্রবর্তন করেন। সেখানে তারা দেখান, পানি ছিটালে যে ক্ষুদ্র কণাগুলো তৈরি হয়, তার কিছুতে বিপরীত বৈদ্যুতিক চার্জ জমে। এরা কাছাকাছি এলে ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয় এবং তা আশপাশের বাতাসে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে পারে, যার ফলে সাধারণ জৈব অণু তৈরি হয়।
তাদের ধারণা, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পৃথিবীতে জীবনের মৌলিক রাসায়নিক উপাদানগুলোর কিছু গঠিত হতে পারে।
সর্বশেষ গবেষণার প্রভাব যদিও তুলনামূলক কম, তবু জারে জানান যে এর পেছনের কার্যপ্রণালী প্রায় একই।
পরীক্ষায় গবেষকরা সহজ এক পদ্ধতি নেন: এক বীকার পানিতে মিথেন ও বাতাস মিশ্রিত বুদবুদ প্রবেশ করান।
হাইস্পিড ভিডিওতে দেখা যায়, বুদবুদ পানির ওপর ফেটে ক্ষুদ্র কণা তৈরি করছে এবং একই সঙ্গে ক্ষীণ আলো জ্বলছে।
তারা ভর স্পেকট্রোমেট্রির সাহায্যে আরও প্রমাণ দেন যে, এই ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ আসলেই মিথেন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে এবং নতুন যৌগ তৈরি করেছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ ওয়েই মিন, যিনি গবেষণায় যুক্ত ছিলেন না, মন্তব্য করেন, 'এই গবেষণা দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত করছে যে উইল-ও'-দ্য-উইস্পস-এর প্রাকৃতিক প্রজ্জ্বলন প্রক্রিয়ার পেছনে মাইক্রোলাইটনিং-ই কাজ করছে।'
তিনি আরও বলেন, কিছু প্রশ্ন এখন' রয়ে গেছে। যেমন- কীভাবে প্রথমে এত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র জলকণার পৃষ্ঠে তৈরি হয়।
তার মতে, এর উত্তর পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং প্রকৌশল— সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
