‘জোর করেই ল্যাবে টেনে নিয়ে গিয়েছিল’: যেভাবে এক তরুণ অফিসকর্মী হয়ে ওঠেন টিভির প্রথম মুখ

সাইকেলের পুরোনো বাতি, ফেলে দেওয়া কাঠ আর বিস্কুটের টিনের মতো ফেলনা জিনিস দিয়ে যে এমন একটা যন্ত্র তৈরি করা যাবে, যা কি না আবার একদিন বদলে দেবে গোটা বিশ্ব; এমনটা কে ভেবেছিল? অথচ শতবর্ষ আগে এমনই এক অবিশ্বাস্য উদ্ভাবনের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল টেলিভিশনের।
স্কটিশ উদ্ভাবক জন লগি বেয়ার্ড ১৯২৫ সালের ২ অক্টোবর প্রথমবারের মতো মানুষের মুখের একটি চলমান ছবি সফলভাবে প্রেরণ করতে সক্ষম হন। আর টেলিভিশনের ইতিহাসের প্রথম তারকা ছিলেন উইলিয়াম টেনটন নামের এক তরুণ অফিসকর্মী। ঘটনার ৪০ বছর পর বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্মৃতিচারণা করেন।
যদিও টেলিভিশন উদ্ভাবনের চেষ্টা বিজ্ঞানীরা ১৮৫০-এর দশক থেকেই করছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভাঙা সাইকেলের বাতি, বাতিল কাঠ আর বিস্কুটের টিন ব্যবহার করে জন লগি বেয়ার্ড নামের এক স্বপ্নবাজ উদ্ভাবকের হাত ধরেই তা বাস্তবে রূপ নেয়। তবে যুগান্তকারী এই সাফল্যের আগে তার জীবন ছিল ব্যর্থতা আর অদ্ভুত সব প্রচেষ্টায় ভরা।
ধর্মযাজকের ছেলে বেয়ার্ড প্রায় সারাজীবনই অসুস্থতায় ভুগেছেন, যে কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও অংশ নিতে পারেননি। যুদ্ধের ময়দানে না গিয়ে একটি বিদ্যুৎ কোম্পানিতে কাজ শুরু করলেও তার উদ্যোক্তা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল তীব্র।
কল্পবিজ্ঞানের লেখক এইচ. জি. ওয়েলসের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি একবার কার্বন থেকে কৃত্রিম হীরা তৈরির চেষ্টা করেন। সেই প্রচেষ্টা সফল তো হয়ইনি, উল্টো গ্লাসগো শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি অংশই তিনি নষ্ট করে ফেলেন।
এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বেয়ার্ড ব্যবসায়িকভাবে কিছু সাফল্য পেতে শুরু করেন। মোজা ও সাবানের ব্যবসা বিক্রি করে পাওয়া সামান্য পুঁজি দিয়ে তিনি ১৯২৩ সালে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের হেস্টিংস শহরে সাদামাটা একটি ঘর ভাড়া নেন।

সমুদ্রের নির্মল বাতাস তার দুর্বল ফুসফুসের জন্য উপকারী হলেও তার কর্মপরিবেশ ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে তিনি টেলিভিশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি গবেষণাগার তৈরি করেন। পুরনো কাঠের চায়ের বাক্সের সঙ্গে ইঞ্জিন লাগিয়ে এবং ফেলে দেওয়া নানা সরঞ্জাম দিয়ে তিনি যন্ত্রপাতি তৈরি করেন।
বেয়ার্ডের এই যন্ত্রের কেন্দ্রে ছিল দ্রুত গতিতে ঘুরতে থাকা একটি বড় চাকতি বা ডিস্ক। এর সাহায্যে ফটোডিটেক্টর এবং তীব্র আলো ব্যবহার করে ছবির প্রতিটি সারিকে স্ক্যান করা হতো। এরপর সেই সংকেত প্রেরণ ও পুনর্গঠন করে চলমান ছবি তৈরি করা হতো। যখন তিনি কোনো বস্তুর ছায়ামূর্তি সফলভাবে পাঠাতে সক্ষম হন, তখনই টেলিভিশন তৈরির কয়েক দশকের স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেতে শুরু করে।
হেস্টিংসের গবেষণাগারে একবার বৈদ্যুতিক শক খেয়ে আহত হওয়ার পর বেয়ার্ড লন্ডনে চলে আসেন। সেখানকার এক ভবনের ছোট একটি কক্ষে নতুন গবেষণাগার স্থাপন করেন। তার যন্ত্র থেকে এত তীব্র তাপ বের হতো যে, পরীক্ষার জন্য তিনি মানুষের বদলে 'স্টুকি বিল' নামের একটি পুতুল ব্যবহার করতে বাধ্য হতেন।
কিন্তু ১৯২৫ সালের ২ অক্টোবর সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি আসে। ৩৭ বছর বয়সী বেয়ার্ড একজন মানুষকে 'গিনিপিগ' হিসেবে ব্যবহার করেন এবং সেই দিনই ঘটে যায় যুগান্তকারী সেই ঘটনা।
সেই ব্যক্তি ছিলেন উইলিয়াম টেনটন, বেয়ার্ডের গবেষণাগারের নিচতলার অফিসে কর্মরত ২০ বছর বয়সী এক অফিস সহকারী। ঘটনার ঠিক ৪০ বছর পর তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'মি. বেয়ার্ড উত্তেজনায় প্রায় দৌড়ে নিচে নেমে আসেন এবং একরকম জোর করেই আমাকে তার ছোট গবেষণাগারে টেনে নিয়ে যান। আমার মনে হয়, তিনি এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। তিনি প্রায় আমাকে জাপটে ধরে যত দ্রুত সম্ভব ওপরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।'
বেয়ার্ডের গবেষণাগারের জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে টেনটন প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তাকে প্রথমে ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা এবং মেঝেতে এলোমেলোভাবে ছড়ানো তারের জঙ্গল পার হতে হয়েছিল। টেনটন বলেন, 'সেই সময়ে তিনি যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতেন, তা ছিল একেবারে বিশৃঙ্খল। কার্ডবোর্ডের চাকতির মধ্যে সাইকেলের লেন্স ও নানা জিনিস লাগানো ছিল। এছাড়া ছিল বিভিন্ন ধরনের বাতি, পুরোনো ব্যাটারি এবং চাকতি ঘোরানোর জন্য কিছু বহু পুরোনো মোটর।'

বেয়ার্ড তাকে ট্রান্সমিটারের সামনে বসিয়ে দেন। টেনটনই ছিলেন সেই জীবন্ত মানুষ, যিনি নড়াচড়া করতে পারতেন, যা স্থির পুতুল 'স্টুকি বিল'-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। টেনটন জানান, তিনি প্রচণ্ড তাপ অনুভব করতে শুরু করেন এবং ভয় পেয়ে যান। তবে বেয়ার্ড তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, চিন্তার কিছু নেই।
টেনটন স্মৃতিচারণা করে বলেন, 'তিনি ছবি দেখতে পাচ্ছেন কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য যন্ত্রের অপর প্রান্তে চলে যান। আমি ফোকাসের মধ্যে এলাম, কিন্তু বাতিগুলো থেকে আসা প্রচণ্ড তাপের কারণে এক মিনিটের বেশি সেখানে থাকতে পারলাম না। তাই আমি সরে এলাম।' এই ঝামেলার জন্য বেয়ার্ড টেনটনের হাতে আড়াই শিলিং তুলে দেন, যাকে বলা হয় 'প্রথম টেলিভিশন ফি'। এরপর তিনি টেনটনকে আবার আগের জায়গায় বসতে রাজি করান।
ছবিতে নড়াচড়া আনার জন্য তিনি টেনটনকে মুখভঙ্গি করতে বলেন। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে টেনটন যখন চিৎকার করে বলেন, 'আমি তো জ্যান্ত ঝলসে যাচ্ছি,' তখন বেয়ার্ডের উত্তর ছিল, 'আর কয়েকটা সেকেন্ড থাকো, উইলিয়াম!'
টেনটন সরে আসার পরপরই বেয়ার্ড যন্ত্রের অপর প্রান্ত থেকে দুই হাত শূন্যে ছুড়তে ছুড়তে দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলেন, 'আমি তোমাকে দেখেছি, উইলিয়াম, আমি তোমাকে দেখেছি! আমি অবশেষে টেলিভিশন পেয়েছি, প্রথম সত্যিকারের টেলিভিশনের ছবি।'
'টেলিভিশন' কী, তা টেনটন বুঝতেই পারছিলেন না। বেয়ার্ড তখন তাকে যন্ত্রের অপর প্রান্তে গিয়ে দেখতে বলেন। টেনটন সেই প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে যান, কারণ তার ভাষায়, 'সেই মুহূর্তে বেয়ার্ডকে আমার কাছে প্রচণ্ড উত্তেজিত এবং কিছুটা উন্মাদ বলে মনে হচ্ছিল।'
একটি ছোট সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে তিনি প্রায় ২ ইঞ্চি বাই ৩ ইঞ্চি (৫ সেমি বাই ৮ সেমি) আকারের একটি ক্ষুদ্র ছবি দেখতে পান।
টেনটন বলেন, 'হঠাৎ করেই বেয়ার্ডের মুখ পর্দায় ভেসে উঠল। তার চোখ বন্ধ করা, মুখ খোলা এবং অন্যান্য নড়াচড়া দেখা যাচ্ছিল। সত্যি বলতে, ছবিটি খুব একটা ভালো ছিল না। কোনো কিছুই স্পষ্ট ছিল না; কেবল ছায়া আর কিছু রেখা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সেটি ছিল একটি ছবি, এবং তা নড়াচড়াও করছিল। আর এটাই ছিল বেয়ার্ডের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তিনি একটি সত্যিকারের চলমান ছবি তৈরি করতে পেরেছিলেন।'
যদিও তিনি বেয়ার্ডকে সরাসরিই বলেন, 'এটা খুবই অস্পষ্ট। আমার তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না।' উত্তরে বেয়ার্ড বলেছিলেন, 'এটাই তো শুরু। তুমি দেখবে, এটি একদিন দেশের প্রতিটি বাড়িতে, এমনকি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।'
বেয়ার্ডের ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি হয়েছিল। পরের বছর ২৬ জানুয়ারি তিনি বিশ্বের সামনে টেলিভিশনের প্রথম প্রকাশ্য প্রদর্শনী করেন। যদিও তার প্রযুক্তি পরবর্তীকালে আরও উন্নত যন্ত্রের কাছে পিছিয়ে পড়েছিল, কিন্তু তিনিই পথ দেখিয়েছিলেন।
১৯৫১ সালে, ৫৭ বছর বয়সে বেয়ার্ডের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর, সোহোর সেই ২২ ফ্রেন্ড স্ট্রিটের ঠিকানায় তাঁর স্মরণে একটি ফলক উন্মোচন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে টেনটনও ফিরে এসেছিলেন। টেলিভিশন সোসাইটির সভাপতি স্যার রবার্ট রেনউইক বলেছিলেন, 'যদিও এই স্মারক ফলকটি লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করা হয়েছে, তাঁর আসল স্মৃতিস্তম্ভ হলো সারা দেশে গজিয়ে ওঠা অ্যান্টেনার জঙ্গল।'
এর ঠিক কয়েক বছর পর, টেনটনের সেই সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরে বলা যায়, সম্প্রচারের ইতিহাসে তার সেই ক্ষণিকের ভূমিকার বদৌলতেই গোটা বিশ্বের মানুষ চাঁদে অবতরণের দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পেয়েছিল। এভাবেই কল্পবিজ্ঞান বাস্তব হয়ে উঠেছিল।