যে কেউ কি হতে পারেন ইনফ্লুয়েন্সার? শূন্য ফলোয়ার নিয়ে তিন ব্যক্তি নিলেন চ্যালেঞ্জ

সোশ্যাল মিডিয়া যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে সবাই 'লাইক' পাওয়ার জন্য লড়াই করে। অন্যের চোখে পড়ার জন্য চলে প্রতিযোগিতা। এক ভুলের জন্য 'ক্যানসেল' হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আর সবাই স্বপ্ন দেখে রাতারাতি 'ভাইরাল' হওয়ার।
কিছু ভাগ্যবান মানুষের জন্য এটা মোটা অঙ্কের আয়ের পথ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৭ সালের মধ্যে কনটেন্ট নির্মাতাদের এই অর্থনীতির বাজার মূল্য হবে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বেশিরভাগের কাছেই সোশ্যাল মিডিয়া এক বিভ্রান্তিকর আর কঠিন জায়গা, যেখানে অ্যালগরিদমই ঠিক করে দেয়, কে তারকা হবে আর কে হারিয়ে যাবে।
তাহলে, এখানে সাফল্য পাওয়াটা আসলে কতটা কঠিন? এই চ্যালেঞ্জটিই নিলেন তিন উদ্যমী ব্যক্তি, যাদের আগে কোনো সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টই ছিল না। তারা মাত্র তিন মাসে নিজেদের প্রতিভাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করেন।
এমিলি, একজন মৃৎশিল্পী এবং স্ট্রোক থেকে বেঁচে ফেরা নারী; অ্যালান, একজন ইতিহাসবিদ; এবং ডানিয়া, একজন মঞ্চশিল্পী—এই তিনজন তাদের অনলাইন খ্যাতির পেছনে ছোটার যাত্রাপথের নানা চড়াই-উতরাই এবং মানসিক টানাপোড়েনের গল্প তুলে ধরেছেন।
'কমেন্টের উত্তর দেওয়াটা রীতিমতো চাপের'
মৃৎশিল্পী হওয়ার আগে এমিলি মঞ্চে অভিনয় করার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ২৬ বছর বয়সে স্ট্রোক তার জীবনটা বদলে দেয়। তার বোঝার ক্ষমতা আগের মতো ছিল না। মাটির কাজ তাকে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা দেয়। সৃজনশীলতার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করাটা তার কাছে থেরাপির মতো মনে হতো।
এমিলি সোশ্যাল মিডিয়া তেমন ব্যবহার করতেন না। কিন্তু তিনি একটি টিকটক অ্যাকাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তিনি "তার মতো পরিস্থিতিতে পড়া মানুষদের কাছে পৌঁছাতে, তাদের অনুপ্রাণিত করতে এবং পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন।"
তার প্রথম ভিডিওতে ভিউ হয় মাত্র দুটি। এরপর মাটির কাজ আর তার বিড়ালকে নিয়ে বানানো ভিডিওগুলোও তেমন সাড়া পায়নি।
কয়েক সপ্তাহের নীরবতা আর সন্দেহের পর, কীভাবে মাটির কাজ তার জীবন বাঁচিয়েছিল, সেই ভিডিওটি হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছায়। অন্যান্য স্ট্রোক থেকে ফেরা ব্যক্তিরা তাকে মেসেজ করে তার কাজের প্রশংসা করেন।

নিজের এই সাফল্যে তিনি গর্বিত ছিলেন। "একটা কমেন্ট আমার কাছে হাজারটা লাইকের চেয়েও বেশি দামী ছিল, কারণ আমি আসলেই কারো মনের কথা ছুঁতে পেরেছিলাম।"
কিন্তু এই সাফল্যের সাথে আসে এক নতুন বোঝা: এত কমেন্টের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি হিমশিম খেয়ে যান।
এমিলি তার কনটেন্টকে স্বাভাবিক রাখতেও হিমশিম খেতে থাকেন। ক্যামেরার সামনে কথা বলতে গেলেই তার মনে হতো, তিনি যেন অভিনয় করছেন।
তিনি বলেন, "আমার মনে হচ্ছে, আমি নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারছি না এবং যা তৈরি করছি তাতে আমি হতাশ। নিজেকে একজন প্রতারকের মতো লাগছে।"
স্ট্রোক থেকে সেরে ওঠার মতো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কথা বলায় ভুলের কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি বলেন, "এখানে ভুলের জায়গা কম, আর আপনি এমন কিছু বলতে চান না যা মানুষ ভুল বুঝতে পারে। এটা নিয়ে সবসময় ভাবতে থাকাটা খুব কঠিন।"
পরীক্ষার শেষের দিকে, এমিলি ব্যক্তিগত জীবনের কিছু সমস্যার কারণে কনটেন্ট বানানো কঠিন মনে করেন। তাই তিনি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তবে ভবিষ্যতে ফিরে আসার সম্ভাবনা রেখেছেন।
'ভিউয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে আত্মসম্মানে ঘা লাগে'
অ্যালান একজন ইতিহাসের অধ্যাপক। তার গবেষণার বিষয় আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং দাড়ির সাংস্কৃতিক ইতিহাস। তিনি দেখেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিষয়ে তেমন কোনো কনটেন্ট নেই।
তিনি এই পরীক্ষায় অংশ নিতে রাজি হন, কারণ তিনি মনে করতেন, একজন শিক্ষক হিসেবে মানুষকে শিক্ষিত করা তার দায়িত্ব।

ইতিহাস কেন ভালোবাসেন, তা নিয়ে তার প্রথম ভিডিওটি কয়েকশ ভিউ পায়। এতে উৎসাহিত হয়ে তিনি প্রতি কয়েকদিন পর পর পোস্ট করতে শুরু করেন।
তার ভিডিওগুলো মোটামুটি ভালো চলছিল, কিন্তু কোনোটিই ১,০০০ ভিউ পার করছিল না। এটা তাকে ক্রমশ হতাশ করে তুলছিল এবং ভিউয়ের পেছনে ছোটাছুটি তাকে মানসিকভাবে ক্লান্ত করে তোলে।
তিনি স্বীকার করেন, "এটা আপনার আত্মসম্মানে আঘাত করতে শুরু করে। ভিউ না পেলে মনে হয়, আপনি হয়তো কিছু ভুল করছেন বা মানুষ আপনাকে পছন্দ করছে না।"
অবশেষে, তার একটি ভিডিও ১০,০০০-এর বেশি ভিউ পায়। কিন্তু তিনি যতটা আনন্দিত হবেন ভেবেছিলেন, ততটা হতে পারেননি।
"আমি মরিয়া হয়ে আরও ভিউ খুঁজছিলাম এবং নিজের অ্যাকাডেমিক সততা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি কিছু তথ্যকে অতিরিক্ত সহজ করে তুলেছিলাম, যা নিয়ে এখন আমার নিজেকে কিছুটা নোংরা লাগছে।"
দুই মাসের মাথায়, অ্যালান একদিন পর পর টিকটকে পোস্ট করছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি অ্যালোপেশিয়ার কারণে তার চুল ও ভুরু না থাকায় কিছু লোক বাজে মন্তব্য করতে শুরু করে।
তিনি স্বীকার করেন, "আমি ভেবেছিলাম এসব মন্তব্য সামলে নেব, কিন্তু এখন এটা বেশ কঠিন মনে হচ্ছে। এর কারণে আমি আমার চেহারা নিয়ে আরও বেশি সচেতন হয়ে পড়েছি।"
তিনি ট্রোলদের জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একটি ভিডিওতে তার অসুস্থতার কথা খুলে বলেন।
একই সময়ে, তার বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নিয়ে প্রচার শুরু করে, যার ফলে তার ভিডিওর ভিউ রকেটের গতিতে বাড়তে থাকে।
তিনি বলেন, "আমার ভিডিওগুলো মোট সাড়ে তিন লক্ষ বার দেখা হয়েছে, অথচ আমার গবেষণাপত্র বছরে মাত্র কয়েকশ বার পড়া হয়।"
কনটেন্ট তৈরি করা তার পেশার জায়গা নেবে না, কিন্তু পেশাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। অ্যালান নিশ্চিত যে তিনি অনলাইনে পোস্ট করা চালিয়ে যাবেন।
'বিশাল সময় খেয়ে নিচ্ছে – অনেকটা নেশার মতো'
মঞ্চশিল্পী এবং প্রযোজক ডানিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জটা ছিল প্রায় বিপরীত। তিনি লাইভ দর্শকের সামনে পারফর্ম করতে অভ্যস্ত, অনলাইনের ক্যামেরার সামনে নয়।
তিনি এই পরীক্ষায় যোগ দেন কারণ তিনি মানুষকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। তার চিন্তা ছিল, মানুষ অতিরিক্ত অনলাইন থাকার কারণে একে অপরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ হারিয়ে ফেলছে।
ডানিয়া ইউটিউব বেছে নেন। এমিলি এবং অ্যালানের তুলনায় তার কনটেন্ট ছিল ধীরগতির এবং লম্বা। তার প্রথম ভিডিওটিই ছিল আট মিনিটের।
তিনি নিয়মিত পোস্ট করছিলেন – মেডিটেশন গাইড থেকে শুরু করে লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় কবিতা রেখে আসা পর্যন্ত। কিন্তু ভিউ তেমন আসছিল না।

তা সত্ত্বেও, তিনি বেশ মজা পাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, "এটা খুব মজার, আর আমি সবসময় ভাবি এরপর কী শেয়ার করব।"
কিন্তু এই উৎসাহ বেশিদিন টেকেনি। শিগগিরই তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রযুক্তিগত দিকগুলো বুঝতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। এমনকি, কীভাবে মিলিয়ন ফলোয়ার পাওয়া যায়, তা নিয়ে একটি বইও কিনে ফেলেন।
এক মাসে তিনি ৫০টি ভিডিও পোস্ট করেন এবং স্বীকার করেন যে এটা মানসিকভাবে খুবই ক্লান্তিকর ছিল।
তিনি বলেন, "এটা আমার বিশাল সময় খেয়ে নিচ্ছে। আমি এটা নিয়েই বাঁচছি, ঘুমাচ্ছি। অনেকটা ড্রাগ বা নেশার মতো লাগছে। প্রতিদিন কনটেন্ট নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত।"
তৃতীয় মাসে এসে ধীরে ধীরে ভিউ বাড়তে থাকে এবং তিনি অনেক ভালো কমেন্ট পেতে শুরু করেন।
অ্যালানের মতো তিনিও আবিষ্কার করেন যে সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতি তার কাজকে এগিয়ে নিতে পারে। তার শো এবং কর্মশালার টিকিট বিক্রিও বেড়ে গেছে।
ডানিয়া ভিউয়ের সংখ্যাকে ব্যক্তিগতভাবে না নেওয়ার চেষ্টা করছেন। পুরস্কারটা যদিও খুব বড় নয়, কিন্তু সাফল্যের এই আশাটাই তাকে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।