সোশ্যাল মিডিয়ায় নিষেধাজ্ঞা: কী আছে অস্ট্রেলিয়ার কিশোরদের ভাগ্যে?
গত আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার অল সেইন্টস অ্যাংলিকান স্কুলের একটি অডিটোরিয়ামে উপস্থিত ছিলেন ৩০০ শিক্ষার্থী। সেখানে ৯ম ও ১০ গ্রেডের শিক্ষার্থীরা হাত তুলে জানান দেন, তাদের খুব কম সংখ্যকই দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানেন। তাদের মধ্যে যারা এ বিষয়ে জানেন, অনেকেই এসময় কিভাবে প্রস্তুতি নেবেন সে বিষয়ে জানেন না।
অনুষ্ঠানে মঞ্চ থেকে সাইবার সুরক্ষা সংস্থা 'কন্ট্রল+শিফট'-এর প্রতিষ্ঠাতা কিরা পেন্ডারগাস্ট বলেন, 'ছবি সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনাদের প্রস্তুত হতে হবে।'
শিক্ষার্থীরা যখন বুঝতে পারে যে তারা কী হারাতে চলেছে, তখন এক উদ্বেগজনক গুঞ্জন পুরো হলরুমে ছড়িয়ে পড়ে। এক ছাত্রী জিজ্ঞেস করে, "১৬ বছর হলে কি অ্যাকাউন্ট ফিরে পাওয়া যাবে?" অন্য একজন জানতে চায়, "বয়স নিয়ে মিথ্যা বললে কী হবে?"
এই নিষেধাজ্ঞার মাত্র দু'সপ্তাহ আগে, আমরা আরও কিছু উত্তর পেয়েছি।
১০ই ডিসেম্বর থেকে, অস্ট্রেলিয়া সরকারের "বয়স-সীমাবদ্ধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম" সংজ্ঞার আওতাভুক্ত সাইটগুলোকে ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্ল্যাটফর্ম থেকে বাদ দেওয়া বা ব্লক করার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় তাদের ৪৯.৫ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার (৩২ মিলিয়ন ডলার) পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
এই তালিকার মধ্যে আছে স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, কিক, রেড্ডিট, থ্রেডস, টিকটক, টুইটার, এক্স ও ইউটিউব। সরকার বলছে, এটি শিশুদের সম্ভাব্য ক্ষতিকর কনটেন্ট থেকে রক্ষা করার জন্য নেওয়া পদক্ষেপ। পক্ষান্তরে, সাইটগুলো বলছে, তারা ইতিমধ্যেই আরও নিরাপদ ব্যবস্থা তৈরির কাজ করছে।
মেটা জানিয়েছে যে তারা ৪ ডিসেম্বর থেকে ১৬ বছরের কম বয়সী ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করা এবং নতুন ফেসুবক, ইন্সটাগ্রাম ও থ্রেডস অ্যাকাউন্ট খোলার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া শুরু করবে। ১৬ বছরের কম বয়সীদেরকে তাদের কনটেন্ট বা তথ্য ডাউনলোড করে রাখার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
স্ন্যাপ জানিয়েছে যে ব্যবহারকারীরা তাদের অ্যাকাউন্টগুলো সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত, অথবা তাদের ১৬ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত, নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারবে। স্ন্যাপ স্ট্রিকস– যেখানে দৈনন্দিন জীবন, ছুটি কাটানো, দেয়াল, কপাল বা অনলাইনে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য যেকোনো কিছুর ছবি প্রতিদিন বিনিময় করা হয় – তা বন্ধ হয়ে যাবে।
এই নিষেধাজ্ঞার আরেকটি কষ্টকর দিক হলো— এটি অস্ট্রেলিয়ার স্কুল বছর শেষ হওয়ার পর এবং দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মের ছুটির ঠিক আগে কার্যকর হচ্ছে। এর ফলে টানা আট সপ্তাহ স্কুল নেই, শিক্ষক নেই – আর কোনো স্ক্রলিংও নেই।
এটি হয়তো কোটি কোটি শিশুর জন্য তাদের প্রথম স্কুল ছুটি হতে চলেছে, যা তারা বছরের পর বছর ধরে সময় কাটানোর জন্য ব্যবহৃত সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমগুলোর সাহায্য ছাড়া কাটাবে, বা বন্ধুদের সাথে সহজে যোগাযোগ করার উপায় ছাড়াই থাকবে। যে সমস্ত অভিভাবক এই নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেন, তাদের জন্যও এটি একটি খুব দীর্ঘ গ্রীষ্ম হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়া যে নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা অনুসরণ করতে সারা বিশ্বের অনেক দেশের নজর এখন তাদের দিকে। অনেকে মনে করছেন, এটি অতীতের সুরক্ষা বিবর্তনের প্রতিচ্ছবি—যেমন একসময় উপলব্ধি করা হয়েছিল যে গাড়িতে সেফটি বেল্ট প্রয়োজন, বা সিগারেটে স্বাস্থ্যের সতর্কতা দেওয়া উচিত।
যে কোনো বড় ধরনের সামাজিক নীতি পরিবর্তনের মতোই এখানেও সমর্থক দল, সমালোচক এবং এমন কিছু লোক রয়েছে যারা নিয়ম ভালোবাসে এমন একটি দেশ (অস্ট্রেলিয়া) তার শিশুদের জন্য কী করছে বা না করছে সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করছে না। তবে, অনেক দেশের নেতারা অস্ট্রেলিয়ার ই-সেফটি তদারককারীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তাদের নিজস্ব আইন তৈরি করছেন, যার ফলে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকুন
৫ বছর বয়সে জুলি ডসন গাড়ির পেছনের আসনে লাফিয়ে বেড়াতেন। তার সেসময়ের কথা মনে আছে।
ইউকে-ভিত্তিক ডিজিটাল পরিচয় সংস্থা ইয়োটি-এর প্রধান নিয়ন্ত্রক ও নীতি কর্মকর্তা ডসন বলেন, "আমার মনে আছে সেই দীর্ঘ গাড়ি ভ্রমণের কথা, যেখানে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কোনো সিট বেল্ট ছিল না।" তিনি আরও বলেন, "১০ ঘণ্টার সফরে আপনি হয়তো এখন আপনার ৫ বছরের শিশুকে দিয়ে সেটা করাবেন না, কিন্তু আমার বেড়ে ওঠার সময়কার স্মৃতি এটাই।"
ডিজিটাল বয়স যাচাইকরণ শিল্পের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ভালো বলে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু ডসন এই সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞাকে একটি স্বাভাবিক বিবর্তন হিসেবে তুলে ধরছেন।
তিনি বলেন, "মানুষ মূলত চিন্তা করেছে যে অফলাইনে আমরা কী করি? আমরা কি অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের স্ট্রিপ ক্লাব, বার-এ প্রবেশ করতে দেই, মদ বা সিগারেট কিনতে দেই? আমাদের কী ধরনের সামাজিক নিয়ম আছে এবং অনলাইনে আমরা কী ধরনের নিয়ম চাই?"
ইয়োটি সংস্থাটি মেটাসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে তাদের বয়স যাচাইকরণের বিকল্পগুলো নিয়ে পরামর্শ দিয়েছে। এই সংস্থাটির বর্তমানে ১২টি পদ্ধতি রয়েছে, যার মধ্যে ফোন, ইমেল এবং আইডি যাচাইকরণ অন্তর্ভুক্ত, এবং এই তালিকা ক্রমশ বাড়ছে। বয়স-সীমা রয়েছে এমন সাইটগুলো ব্যবহারকারীদের তারা তাদের পছন্দের পদ্ধতি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়।
ডসন বলেন, "সারা বিশ্বে, যখন মানুষের কাছে একাধিক বিকল্প থাকে, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেহারা থেকে বয়স অনুমান পদ্ধতিটি বেছে নেয়।" এই পদ্ধতিতে ভিডিও সেলফি ব্যবহার করে ত্বকের গঠন এবং হাড়ের কাঠামোর মতো মুখের বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একজন ব্যক্তির বয়স অনুমান করা হয়। আইন অনুসারে মানুষকে তখন আর সরকারি পরিচয়পত্র আপলোড করতে হয় না।
তবে, লন্ডন-ভিত্তিক আরেকটি বয়স যাচাইকরণ সংস্থা ভ্যারিফাইমাই-এর ক্লায়েন্টদের মধ্যে রয়েছে ইউটিউব। ভ্যারিফাইমাই-এর প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা অ্যান্ডি লুলহাম বলেন, ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মতো "বর্ডারলাইনে থাকা" কিশোর-কিশোরীদের বয়স নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে। কিছু ১৬-ঊর্ধ্ব ব্যক্তিদেরও এই নিষেধাজ্ঞা এড়াতে "পরিচয়পত্র" দেখাতে হতে পারে।
তিনি বলেন, "সব ১৬ বা ১৭ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের কাছে পরিচয়পত্র নাও থাকতে পারে বা সেগুলোর সহজলভ্যতা নাও থাকতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, প্ল্যাটফর্মগুলো এই সমস্যাটি কীভাবে সমাধান করবে, সে বিষয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।"
বছরের শুরুতে, অস্ট্রেলিয়ার কিশোর-কিশোরীরা লক্ষ্য করছিলেন, কীভাবে ব্রিটিশ কিশোররা ইউকের অনলাইন সেফটি আইন অনুসারে নতুন বয়স সীমাবদ্ধতা এড়ানোর চেষ্টা করেছে—সস্তা ফেস মাস্ক এবং ভিডিও গেম চরিত্রের ছবি ব্যবহার শুরু করে।
লুলহ্যাম বলেন, এই ধরনের ফাঁকি ধরার জন্য অ্যান্টি-স্পুফিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা লাইভনেস চেকের মাধ্যমে নিশ্চিত করে যে ক্যামেরার সামনে আসল মানুষ রয়েছে।
ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করাও একটি সুপরিচিত কৌশল। লুলহামের মতে, পর্ন-এর মতো নিষিদ্ধ কনটেন্ট দেখতে ভিপিএন ব্যবহার কাজে এলেও, সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে এটি খুব বেশি জনপ্রিয় হবে না।
তিনি বলেন, "সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো অঞ্চলভিত্তিক তথ্য, আপনি কোথায় আছেন সেই প্রেক্ষাপট, আপনার বন্ধু, আপনার সংযোগ এবং আপনি কাকে অনুসরণ করেন—এসবের ওপর বেশি নির্ভর করে।" তিনি আরও বলেন, "সুতরাং, আমার মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে ভিপিএন ব্যবহার করলে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতার ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।"
পরিশেষে, ডসন পরামর্শ দেন যে প্ল্যাটফর্মগুলোকে যদিও ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য প্রবেশপথ বন্ধ করতে হবে, তবে দুর্গটি সম্পূর্ণরূপে অভেদ্য হবে না। আইনের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন তারা ১৬ বছরের কম বয়সীদের তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে রাখতে "যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ" নেয়। তবে নিষেধাজ্ঞা থাকা অ্যাপ ব্যবহার করলে শিশু বা তাদের অভিভাবকদের জন্য কোনো শাস্তির বিধান নেই।
তিনি বলেন, "(সরকার) সেই সব অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের শাস্তি দিতে আগ্রহী নয় যাদের ১৬ বছর হতে আর মাত্র দুই মাস বাকি।"
ডসন বলেন যে তিনি যদি একজন কিশোরী হতেন, তাহলে সম্ভবত তিনি নিরাপত্তা ত্রুটি খুঁজে বের করতেন। তিনি বলেন, "আমি নিশ্চিত যে আমি তাদের মধ্যে একজন হতাম যারা (সমস্যা সমাধানের জন্য) কোমর বেঁধে নামত।"
টিকটক-এর কিশোর-কিশোরীরা খুশি নয়
শার একজন ১৫ বছর বয়সী কিশোরী। সে গায়িকা হতে আগ্রহী। সে সোশ্যাল মিডিয়ার ভালো-মন্দ দুটো দিকই জানেন।
অনলাইনে এতটাই খারাপভাবে উৎপীড়নের শিকার হয়েছিলেন যে তাকে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল, কিন্তু সে তার গানের প্রচারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করেন এবং তা হারাতে চান না।
তিনি বলেন, "পোস্ট করে আমার প্রধান অ্যাকাউন্টে চার হাজার ফলোয়ার জোগাড় করতে আমার অনেক সময় লেগেছে, আর আমি সেই সব হারাতে চলেছি। আমার গান শোনার জন্য আমি যে প্রতিটি মানুষকে জড়ো করেছিলাম—সব শেষ হয়ে যাবে।"
অন্যান্য কিশোর কনটেন্ট নির্মাতাদের মতো, শার এখন তার ফলোয়ারদের লেমন৮-এ যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করছে। লেমন৮ একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ যা টিকটকের মূল কোম্পানি বাইটড্যান্সের এবং এটি নিষিদ্ধ নয়।
শারের বাবা, রিচি শারল্যান্ড বলেন, যদি তিনি আবার সময় পেতেন, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার প্রবেশ কিছুটা দেরিতে, সম্ভবত ১৩ বা ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত, স্থগিত করতেন, যাতে সে আরও পরিপক্ব হয়ে অনলাইনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। তিনি আরও বলেন, 'এটি শুধু তার সমস্যা নয়, সব কিশোর-কিশোরীর ক্ষেত্রেই এমনটা হয়।'
কিশোরী ইনফ্লুয়েন্সার জোয়ি-ও এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সে প্রায় ৪৮ হাজার ফলোয়ারের সাথে সংযুক্ত থাকতে টিকটক ব্যবহার করে থাকে। সেখানে সে গেট রেডি উইথ মি হ্যাসট্যাগ এবং আনবক্সিং ভিডিও পোস্ট করে, এবং—সম্প্রতি—১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য কীভাবে বয়স শনাক্তকরণ এড়ানো যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।
জোয়ির অ্যাকাউন্টে তার বাবার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তার ভিডিওতে সে পরামর্শ দিয়েছে, "আপনার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের ইমেল অ্যাড্রেস আপনার বাবা-মায়ের ইমেল দিয়ে পরিবর্তন করুন।" (টিকটক বলছে অ্যাকাউন্টের নাম গুরুত্বপূর্ণ নয়—তাদের প্রযুক্তি কে সবচেয়ে বেশি এটি ব্যবহার করছে তা শনাক্ত করতে পারে।)
অবশ্য জোয়ির বাবা-মা সোশ্যাল মিডিয়ায় তার এই কার্যকলাপ সমর্থন করেন এবং বিশ্বাস করেন যে এটি তার জন্য ভালো হয়েছে। তার বাবা মার্ক 'ইউথ জ্যাম' পডকাস্টকে বলেন, "সে যা করেছে এবং যেভাবে করেছে, তা অসাধারণ।"
জোয়ি সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার বয়সসীমা কমিয়ে ১৩ বছর করার দাবিতে একটি পিটিশন শুরু করেছিল, যা বুধবার বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল।
তবে ৯ম গ্রেডের শিক্ষার্থী ম্যাক্সিন স্টিল তাতে স্বাক্ষর করেনি। তার স্ক্রলিং বন্ধ করা খুব কঠিন মনে হওয়ায় সে গত বছরই তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপগুলো ডিলিট করে দেন। বর্তমানে, তার কাছে ফোনই নেই।
এই শিক্ষাবর্ষের শেষ টার্মের জন্য, সে ভিক্টোরিয়া রাজ্যের হাই কান্ট্রিতে আলপাইন স্কুলে প্রায় ৪০ জন ১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর সাথে একটি লিডারশিপ ক্যাম্পে রয়েছে, যেখানে ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ।
স্কুল-অনুমোদিত একটি কলে ম্যাক্সিন বলেন, "প্রথম সপ্তাহে... আমরা সবাই আলোচনা করছিলাম যে কীভাবে আমরা সবাইকে মিস করছি, আমরা বন্ধুদের সাথে কথা বলতে পারছিলাম না, এবং আমরা যেন কেবল স্ক্রলিং মিস করছিলাম।"
তিনি আরও বলেন, 'এখন আমরা সত্যিই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভুলে গেছে, এবং আমি বলতে পারি, এটি আমার পুরো জীবনেই সবচেয়ে জীবন্ত এবং প্রাণবন্ত পরিবেশ যা আমি আগে কখনও দেখিনি।'
ম্যাক্সিন হলো প্রোজেক্ট রকিট-এর ন্যাশনাল ইয়ুথ কালেক্টিভ-এর একজন সদস্য—যা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ৫০ জন তরুণ-তরুণীর একটি দল। এ দলটি ধর্ষণ, ঘৃণা এবং কুসংস্কার মোকাবিলার জন্য তৈরি করা প্রোগ্রামগুলোতে তথ্য দিয়ে সাহায্য করে।
প্রোজেক্ট রকিট স্কুলগুলোতে কাজ করে এবং স্ন্যাপচ্যাট, স্পটিফাই ও মেটার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম বিভিন্ন প্রযুক্তি সংস্থাকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান করে।
প্রোজেক্ট রকিট-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও লুসি থমাস বলেন, যদিও ম্যাক্সিন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থেকে ক্ষমতায়ন অনুভব করছে, কিন্তু অন্য শিশুরা তাদের সহায়তা গোষ্ঠী এবং তাদের মতো অন্যদের সাথে যোগাযোগ হারানোর কারণে আসলে কষ্ট অনুভব করছে।
থমাস বলেন, "এই প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে তরুণ-তরুণীদের সম্পর্ক সত্যিই জটিল এবং বৈচিত্র্যময়, এবং যেখানে কেউ কেউ এগুলো ছাড়া ভালো থাকে, সেখানে অন্যরা সংযুক্ত থাকার প্রাথমিক উপায় হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াকে সত্যিই ব্যবহার করে।"
ন্যাশনাল ইয়ুথ কালেক্টিভ বর্তমানে বিচ্ছিন্ন, প্রান্তিক এবং নিঃসঙ্গ শিশুদের কাছে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। থমাস বলেন, "আমরা কিছুতেই চাই না যে একটি নীতির উদ্দেশ্য তাদের নিরাপদ রাখা হলেও, তার ফলে তারা যেন আরও বিপজ্জনক, কম নিয়ন্ত্রিত প্ল্যাটফর্মগুলোতে চলে যায়।"
প্রচারণা বাড়ছে
আমরা কীভাবে এই জায়গায় পৌঁছালাম তা মনে রাখা দরকার। এই নিষেধাজ্ঞার উৎপত্তির পিছনে ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয় এক অস্ট্রেলিয়ান রাজ্যের প্রিমিয়ারের স্ত্রীকে, যিনি মার্কিন মনোবিজ্ঞানী এবং লেখক জোনাথন হাইডট-এর লেখা "দি অ্যাংশাস জেনারেশন" বইটি পড়েছিলেন এবং তার স্বামীকে এ বিষয়ে কিছু করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
তার বইতে হাইডট শিশুদের এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার উত্থানের জন্য পর্যবেক্ষণহীন আউটডোর খেলার অভাব এবং স্মার্টফোনের ব্যাপক বিস্তারকে দায়ী করেন।
এই ধারণাটি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আগে, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এই নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কাজ করতে পারে তা নিয়ে একটি অনুসন্ধান শুরু করে। এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া জগতে প্রভাবশালী নিউজ কর্পোরেশন এবং সিডনির একজন রেডিও উপস্থাপকের প্রচারণাও, যিনি "৩৬ মান্থ" নামে একটি প্রচারণার অধীনে অনলাইনে উৎপীড়নের কারণে আত্মহত্যা করা পরিবারগুলোর গল্প তুলে ধরেতেন।
গত বছরের সংসদের শেষ দিনে পাস হওয়া জাতীয় বিলটি সেই সময় সমালোচিত হয়েছিল এই বলে যে এটি ২০২৫ সালের নির্বাচনের আগে ভোট জেতার উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়ো করে তৈরি করা আইন।
এই সপ্তাহেই, এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গঠিত প্রচার গোষ্ঠী 'ডিজিটাল ফ্রিডম প্রজেক্ট' অস্ট্রেলিয়ার হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেছে। তারা যুক্তি দিয়েছে যে এটি তরুণ অস্ট্রেলিয়ানদের রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর একটি "প্রকাশ্য আক্রমণ"। এই গোষ্ঠীর সভাপতি হলেন নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সংসদের একজন লিবার্টারিয়ান পার্টির সদস্য, যিনি এর আগে সরকারি স্বাস্থ্য বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে লবিং করেছিলেন। যেকোনো আদালতের শুনানিতে সময় লাগবে।
যোগাযোগমন্ত্রী আনিকা ওয়েলস বুধবার ফেডারেল পার্লামেন্টে এর কড়া জবাব দেন। তিনি বলেন, "আমরা কোনো হুমকি দ্বারা ভীত হব না। আমরা আইনি চ্যালেঞ্জ দ্বারা ভীত হব না। আমরা বিগ টেক দ্বারা ভীত হব না। অস্ট্রেলিয়ার অভিভাবকদের পক্ষ থেকে, আমরা আমাদের অবস্থানে অটল থাকবো।"
অন্যান্য দেশও তাদের নিজস্ব বিধিনিষেধের প্রস্তাব করছে। ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইন-এর প্রভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুড়ে থাকা দেশগুলোর তালিকায় এই সপ্তাহে মালয়েশিয়াও যোগ দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের 'অনলাইন সেফটি অ্যাক্ট' এমন সংস্থাগুলোর জন্য বহু মিলিয়ন ডলার জরিমানার হুমকি দিয়েছে যারা ক্ষতিকর বিষয়বস্তু থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হবে। এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স অফ স্টেট লেজিসলেচার্সের মতে, এই বছর অন্তত ২০টি মার্কিন রাজ্য শিশু ও সোশ্যাল মিডিয়া সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছে, তবে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার মতো এত ব্যাপক আইন কোনোটিই নয়।
অলাদাভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের শত শত ব্যক্তি, স্কুল জেলা এবং অ্যাটর্নি জেনারেলরা মেটা, ইউটিউব, টিকটক ও স্ন্যাপচ্যাটের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে এই কোম্পানিগুলো শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে বিজ্ঞাপন রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সচেতনভাবে আসক্তি সৃষ্টি করা বৈশিষ্ট্য তাদের প্ল্যাটফর্মে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
মেটা, টিকটক ও স্ন্যাপের মুখপাত্ররা বলেছেন যে, এই অভিযোগ তাদের প্ল্যাটফর্ম এবং নিরাপত্তা প্রচেষ্টার একটি ভুল ধারণা উপস্থাপন করছে। এ বিষয়ে ইউটিউবের কাছে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে।
কন্ট্রল+শিফট-এর প্রধান ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিস্ট পেন্ডারগাস্ট মনে করেন, বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা সীমিত করার পদক্ষেপ অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল।
তিনি অল সেইন্টস অ্যাংলিকান স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীসহ অস্ট্রেলিয়ার হাজার হাজার শিশুর সাথে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা নিয়ে কথা বলেছেন এবং তিনি আশ্বস্ত যে এই নিষেধাজ্ঞা ২০২৬ সালে তাদের আরও সুরক্ষিত করে তুলবে।
তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় পরের বছর পরিস্থিতি খুবই আলাদা হবে। কিছুটা সময় লাগবে, কিন্তু আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে অভিভাবকরা যেন তাদের সন্তানদের শেখাতে পারে যে... কী রাখতে হবে এবং কী রাখতে হবে না, এবং তাদের জন্য আরও নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম খোঁজা শুরু করতে হবে।'
তবে, অল সেইন্টস জুনিয়র স্কুলের শিক্ষার্থী ব্যস্ততা ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান নিকি বাকলি ২০২৬ সালে খুব বেশি পরিবর্তন আশা করছেন না। তিনি বলেন, "আমার মনে হয় না কিছু অভিভাবক এটি সরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট দৃঢ় হবেন।"
তার উদ্বেগ সরকারের সেই গেমিং সাইটগুলো নিয়েও রয়েছে, যেগুলো নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে না বলে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যেমন রোব্লক্স, ডিসকর্ড ও স্টিম।
তিনি বলেন, "এটি আমাকে ভীষণ আতঙ্কিত করে। আমার দুই বছরের বয়সীর ছোট বাচ্চারা অনলাইনে আছে এবং অচেনা ব্যক্তিদের মেসেজ করছে, এবং এটি ঠিক নয়।'
বাকলি জানান, সম্প্রতি একদল মেয়ে তাকে বলেছে যে তাদের ৭ বছর বয়সী বন্ধু একটি গেমিং সাইটে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলেছে। ওই ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কোথায় থাকে। বাকলি বিষয়টি তার মাকে জানালে জানান, তিনি জানতেনই না যে তার মেয়ে অনলাইনে অন্য লোকেদের সাথে কথা বলছে।
রোব্লক্স গেমিং সাইটগুলোর মধ্যে অন্যতম, যার বিরুদ্ধে প্রায়শই অনলাইনে শিকারী থেকে শিশুদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনা হয়। তারা নভেম্বরের শেষের দিকে চ্যাটের জন্য বয়স যাচাইকরণ বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। কিন্তু কিছু অভিভাবকের মতে, এটি যথেষ্ট নয়।
বাকলি জানান যে অল সেইন্টস স্কুলের অভিভাবকরা স্মার্টফোন ব্যবহারের বিরোধিতা করার জন্য একটি ক্লাব তৈরি করেছেন, যেখানে তারা সোশ্যাল মিডিয়ার বিপদ সম্পর্কিত বইয়ের নাম এবং খবরের নিবন্ধ একে অপরের সাথে আদান-প্রদান করেন।
বাকলি বলেন, "আমাদের প্রথম মিটিংয়ে ৭৬ জন অভিভাবক এসেছিলেন, যা আমাদের অবাক করে দিয়েছিল।" তিনি আরও বলেন, "আবেগকে ধরে রাখা যাচ্ছিল না। সবাই একসাথে কথা বলছিল এবং তারা একজোট হচ্ছিল এই বলে যে, আমাদের একত্রিত হতে হবে এবং এটি বন্ধ করতে হবে।"
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া ১৪ বছর বয়সী ম্যাক্সিন বলেছে যে, কিছু দিক থেকে সে এখন আর গসিপ এবং মিমস থেকে বাদ পড়া একমাত্র ব্যক্তি হবে না—এই ভেবে সে খুশি।
তার সমবয়সী অন্যান্য শিশুদের প্রতি তার বার্তা হল—১৬ বছর বয়সে সবাই আবার লগ ইন করার আগে এই শান্তি উপভোগ করো।
ম্যাক্সিন বলেন, "আপনার বয়স যদি আমার কাছাকাছি হয়, তাহলে এমনিতেই পরের বছর আবার ফিরে পাবেন। তাই কেন ৩৬৫ দিনের জন্য শান্তি এবং নীরবতা উপভোগ করবেন না। এখানে আপনি কেবল নিজের দিকে মনোযোগ দেবেন এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে আপনার শৈশবের শেষ বছরগুলো উপভোগ করার চেষ্টা কেন করবেন না?"
