যেভাবে ১০ লক্ষ বছরের পুরোনো খুলি মানব বিবর্তনের ধারণা বদলে দিল

চীনে আবিষ্কৃত এক মিলিয়ন বছরের পুরোনো মানুষের খুলি থেকে ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্স এতদিনের ধারণার তুলনায় অন্তত পাঁচ লাখ বছর আগেই আবির্ভূত হয়েছিল। নতুন এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এ দাবি করেন।
তারা বলছেন, এ আবিষ্কার প্রমাণ করছে যে মানুষ আরও অনেক দীর্ঘ সময় ধরে অন্যান্য নিকটাত্মীয় প্রজাতি, যেমন নিয়ানডারথালের সঙ্গে সহাবস্থান করেছে। গবেষকরা মনে করছেন, এ বিশ্লেষণ মানব বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে এবং আমাদের ইতিহাসের শুরুর গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নতুনভাবে লিখতে হতে পারে।
তবে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, গবেষণার ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য হলেও তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক জার্নাল 'সায়েন্স'-এ প্রকাশিত গবেষণাটিতে অংশ নেন চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষকেরা। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিজুন নি বলেন, 'ফলাফল হাতে পাওয়ার পর প্রথমে আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি। এত দূর অতীতে আমাদের প্রজাতি থাকতে পারে, এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কিন্তু নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর আমরা এখন নিশ্চিত এবং একইসঙ্গে অত্যন্ত আনন্দিত।'
'ইউনক্সিয়ান–২' নামের খুলিটি আবিষ্কারের পর গবেষকরা প্রথমে ভেবেছিলেন এটি বৃহৎ মস্তিষ্কবিশিষ্ট প্রথম মানুষ 'হোমো ইরেকটাস' প্রজাতির। কারণ খুলিটির বয়স এক মিলিয়ন বছর, যা উন্নত মানুষের আবির্ভাবের সময়ের অনেক আগের। প্রায় ৬ লাখ বছর আগে হোমো ইরেকটাস নিয়ানডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স-এ বিভক্ত হয়ে যায়।
কিন্তু নতুন বিশ্লেষণে দেখা যায়, 'ইউনক্সিয়ান–২' হোমো ইরেকটাস নয়; বরং এটি ছিল হোমো লঙ্গি নামের এক প্রজাতির, যারা নিয়ানডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স-এর সমপর্যায়ের। জিনগত প্রমাণ অনুযায়ী, এ প্রজাতি মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করেছে। ফলে যদি এক মিলিয়ন বছর আগে 'ইউনক্সিয়ান–২' পৃথিবীতে বিচরণ করে থাকে, তবে নিয়ানডারথাল ও আমাদের প্রজাতির প্রাথমিক সংস্করণও তখন অস্তিত্বশীল ছিল বলে ধারণা করা যায়।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অধ্যাপক ক্রিস স্ট্রিঞ্জার বলেন, 'এ আবিষ্কার বৃহৎ মস্তিষ্কবিশিষ্ট মানুষের বিবর্তনের সময়রেখাকে অন্তত পাঁচ লাখ বছর পেছনে নিয়ে গেছে।' তিনি ধারণা করেন, পৃথিবীর কোথাও হয়তো এক মিলিয়ন বছর পুরনো হোমো সেপিয়েন্স–এর জীবাশ্ম রয়েছে, যা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিশ্লেষণে খুলির গঠন ও জিনগত উপাত্ত—উভয় পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছে, এবং দুই ক্ষেত্রেই একই ফলাফল এসেছে। তবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবিষয়ক জেনেটিসিস্ট ড. আইলউইন স্কালি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'এ ধরনের সময় নির্ধারণ খুব কঠিন। ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য হলেও নিশ্চিত নয়, আরও প্রমাণ প্রয়োজন।'
এখন পর্যন্ত আফ্রিকায় প্রাচীন হোমো সেপিয়েন্স–এর প্রমাণ ৩ লাখ বছর আগের। তাই হয়তো এ প্রজাতির উৎপত্তি প্রথমে এশিয়াতেই হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। তবে অধ্যাপক স্ট্রিঞ্জার সতর্ক করে বলেন, 'ইউরোপ ও আফ্রিকায় এক মিলিয়ন বছর পুরনো মানুষের জীবাশ্মও রয়েছে, যেগুলো বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।'
এ প্রাথমিক সময়রেখা অনুযায়ী, হোমো সেপিয়েন্স, হোমো লঙ্গি ও নিয়ানডারথাল প্রায় ৮ লাখ বছর একসঙ্গে সহাবস্থান করেছে। এ সময় তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রজনন করেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
গবেষকেরা বলছেন, এ আবিষ্কার দীর্ঘদিন ধরে 'মিডল প্লাইস্টোসিন' সময়ের অগণিত জীবাশ্ম শ্রেণিবিন্যাসের জটিলতা দূর করতে সাহায্য করছে। এখন এগুলোকে সহজেই তিনটি প্রধান প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
অধ্যাপক নি বলেন, 'মানব বিবর্তন একটি বৃক্ষের মতো। এর তিনটি প্রধান শাখা দীর্ঘদিন সহাবস্থান করেছে, এবং তারা পরস্পরের সঙ্গে প্রজননও করেছে। এ সত্যিই এক অবিশ্বাস্য ফলাফল।'
চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে খননকৃত এই খুলি ও আরও দুটি খুলি ক্ষতিগ্রস্ত ও ভাঙা ছিল। এ কারণে এগুলো আগে হোমো ইরেকটাস ভেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা কম্পিউটার মডেলিং ও ৩ডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে খুলির আদল পুনর্গঠন করে সেগুলোকে নতুন ও আরও উন্নত প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।