ইংল্যান্ডে মিলল মানুষের আগুন জ্বালানোর প্রাচীনতম প্রমাণ
ইংল্যান্ডের সাফোক কাউন্টিতে এক অভাবনীয় আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আগুন জ্বালানোর সবচেয়ে পুরনো প্রমাণ মিলেছে সেখানে। প্রায় ৪ লাখ ১৫ হাজার বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা এই আগুন বা চুলা তৈরি করেছিল। এই আবিষ্কার মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে এক নতুন মোড় এনে দিয়েছে। কারণ এতদিন ধারণা করা হতো মানুষ আগুন জ্বালানো শিখেছে আরও অনেক পরে।
বার্নহ্যাম গ্রামের কাছে ইটের তৈরির পুরনো এক মাটির গর্তে গবেষকরা এই প্রমাণ পান। সেখানে পোড়া মাটি এবং তাপে ফেটে যাওয়া ফ্লিন্ট পাথরের কুড়াল পাওয়া গেছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো, সেখানে দুই টুকরো 'আয়রন পাইরাইট' বা বিশেষ খনিজ পাথরও মিলেছে। এই পাথর ফ্লিন্টের সঙ্গে ঘষলে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। গবেষকরা একে বারবার ব্যবহৃত ক্যাম্পফায়ার বা বনভোজনের আগুন হিসেবে শনাক্ত করেছেন।
প্রাচীনকালে এখানে একটি জলাশয় ছিল। মানুষেরা হয়তো পানির উৎসের কাছেই তাবু গেড়েছিল।
লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রত্নতাত্ত্বিক নিক অ্যাশটন এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন। বুধবার 'নেচার' জার্নালে তাদের গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। অ্যাশটন বলেন, 'আমরা মনে করি মানুষ আগুন জ্বালানোর উদ্দেশ্যেই এখানে পাইরাইট পাথর এনেছিল। আগুন জ্বালানোর ইতিহাস যে কতটা পুরনো, এই ঘটনা তা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।'
এতদিন পর্যন্ত আগুন জ্বালানোর সবচেয়ে পুরনো প্রমাণ ছিল প্রায় ৫০,০০০ বছর আগের। সেটি ছিল উত্তর ফ্রান্সে। সেই আগুনও নিয়ান্ডারথালরা জ্বালিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
আগুন নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের বিবর্তনে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধু রান্না বা শিকারি প্রাণী থেকে বাঁচার জন্য নয়, শীতপ্রধান এলাকায় টিকে থাকার জন্যও জরুরি ছিল। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রত্নতাত্ত্বিক এবং গবেষণার সহ-লেখক রব ডেভিস বলেন, 'যেমন ব্রিটেনের মতো জায়গাগুলোতে শীতের হাত থেকে বাঁচতে আগুন ছিল ভরসা।'
রান্নার মাধ্যমে আমাদের পূর্বপুরুষরা মাংসের জীবাণু এবং গাছের মূল বা কন্দের বিষ নষ্ট করতে পারত। রান্না খাবারকে নরম ও সহজে হজমযোগ্য করত। এতে শরীর বাড়তি শক্তি পেত, যা মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করত। গবেষকদের মতে, নানা ধরণের খাবার খেতে পারায় তাদের বেঁচে থাকা সহজ হয়। এতে বড় দল নিয়ে তারা থাকতে পারত।
আগুন হয়তো সামাজিক বিবর্তনেও সাহায্য করেছে। রাতে আগুনের পাশে বসে মানুষ আড্ডা দিত। হয়তো গল্প বলা, ভাষা তৈরি বা বিশ্বাসের জন্ম সেখান থেকেই। ডেভিস বলেন, 'ক্যাম্পফায়ার হয়ে ওঠে এক সামাজিক কেন্দ্র।' তিনি আরও বলেন, 'আমরা এমন এক প্রজাতি যারা আগুন ব্যবহার করে আমাদের চারপাশকে গড়ে তুলেছি।' এই বৈশিষ্ট্যটি হোমো স্যাপিয়েন্সের সঙ্গে নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানদেরও ছিল।
বার্নহ্যামের এই জায়গাটি আফ্রিকায় পাওয়া সবচেয়ে পুরনো হোমো স্যাপিয়েন্স ফসিলের চেয়েও প্রাচীন। গবেষকরা বিশ্বাস করেন, আমাদের বিবর্তনীয় কাজিন নিয়ান্ডারথালরাই এই আগুন জ্বালাত। এটি প্রমাণ করে যে এই আদিম মানুষেরা বেশ বুদ্ধিমান ছিল। যদিও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে তাদের প্রায়ই বোকা ভাবা হয়।
গবেষণার আরেক সহ-লেখক প্যালিওনথ্রোপলজিস্ট ক্রিস স্ট্রিংগার বলেন, বার্নহ্যামে মানুষের কোনো ফসিল পাওয়া যায়নি। তবে তিনি জানান, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দক্ষিণের শহর সোয়ানসকোম্বে ৪ লাখ বছরের পুরনো মানুষের মাথার খুলির টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। বার্নহ্যাম থেকে জায়গাটি ১০০ মাইলেরও কম দূরে। ওই খুলি স্পেনের একটি গুহায় পাওয়া ৪ লাখ ৩০ হাজার বছর আগের নিয়ান্ডারথাল ফসিলের সঙ্গে মিলে যায়।
স্ট্রিংগার বলেন, 'তাই বার্নহ্যামের আগুন জ্বালানো ব্যক্তিরা খুব সম্ভবত আদিম নিয়ান্ডারথাল ছিল। সোয়ানসকোম্ব এবং স্পেনের সিমা মানুষদের মতো।'
প্রায় ৩৯,০০০ বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আধুনিক মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্সরা ইউরোপে আসার কিছু পরেই এটা ঘটে। তবে বিলুপ্ত হওয়ার আগে তাদের সঙ্গে হোমো স্যাপিয়েন্সদের প্রজনন হয়েছিল। তাই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জিনোমে বা বংশগতিতে তাদের অস্তিত্ব রয়ে গেছে।
আগের প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ থেকে বিজ্ঞানীরা ওই সময়ের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তখন সেখানে হাতি থেকে শুরু করে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখি ছিল। পশুর হাড়ে কাটা দাগ থেকে মানুষের উপস্থিতির প্রমাণও মিলেছে।
আফ্রিকায় ১০ লাখ বছরেরও বেশি আগে মানুষের আগুন ব্যবহারের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আছে। তবে সেগুলো ছিল দাবানল বা বজ্রপাত থেকে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি আগুন। সেখানে ইচ্ছে করে আগুন জ্বালানোর কোনো প্রমাণ ছিল না।
বার্নহ্যামের আগুন যে ইচ্ছে করে জ্বালানো হয়েছিল, তা প্রমাণ করতে গবেষকরা চার বছর ধরে পরীক্ষা চালিয়েছেন। তারা জিওকেমিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে সেখানে তাপমাত্রা ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল। আর একই জায়গায় বারবার আগুন জ্বালানো হয়েছে। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা তাদের দাবির সত্যতা প্রমাণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
