আমরা কি আমেরিকান সাম্রাজ্যের পতন প্রত্যক্ষ করছি?
মাইক ডানকান জানেন কীভাবে সাম্রাজ্য পতন ঘটে। তিনি তার রেভল্যুশনস অ্যান্ড দ্য হিস্ট্রি অব রোম পডকাস্টে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পতন, অস্থিরতা এবং শাসন পরিবর্তনের কাহিনী বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। দ্য হিস্ট্রি অব রোম–এর ১৭৯ পর্ব, ৭৩ ঘণ্টার সেই বিশাল প্রকল্পে রোমান প্রজাতন্ত্র ও সাম্রাজ্যের জন্ম থেকে পতন পর্যন্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাই তিনি খুব ভালো জানেন, কখন কীভাবে সব ভেঙে যায়। কখন ভুলপথে যাত্রা শুরু করে সাম্রাজ্যের শাসকবর্গ।
২০২৫ সালে এসে ডানকান স্পষ্ট করে বলছেন, গত এক শতক ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করা আমেরিকান সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ সময়কে পার করে এসেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় আমেরিকান শাসনকাঠামোর লালিত আদর্শের অবক্ষয় এমনভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে, যা বর্তমান সময়ের অনন্য প্রেক্ষাপট ছাড়া সম্ভব ছিল না। একইসঙ্গে এটি শত শত বছরের পুরোনো রাজনৈতিক শক্তির রাতারাতি নাটকীয় পরিবর্তনের হাত ধরে পতনের পূর্বনির্ধারিত চক্রের সঙ্গেও মিলে যাচ্ছে।
"সবকিছুরই একটা শেলফ লাইফ (টিকে থাকার সময়সীমা) আছে," ডানকানকে উদ্ধৃত করে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনের নিবন্ধ লেখা হয়েছে। ডানকান আরও বলেছেন, "প্রত্যেক শক্তিরই একটি জীবনকাল থাকে, আর একসময় তা পতনের দিকে যায়। যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশাল শক্তিধর, এটা কোনোভাবেই হঠাৎ করে বিশ্ব শক্তির সমীকরণ থেকে হারিয়ে যাবে না। কিন্তু এই ব্যবস্থা কি নিজেই নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? হ্যাঁ, সেটাই যেন মনে হচ্ছে।"
তাহলে, আমেরিকান এক্সপেরিমেন্টের ধীরে ধীরে খসে পড়া কাঠামোকে কীভাবে দেখা যায় বৈশ্বিক ইতিহাসের মহান পতন ও বিপ্লবের যুগগুলোর সঙ্গে তুলনা করে? এ বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পাঠক নিঃসন্দেহে ডানকান।
রোমের সাথে তুলনা
দ্য হিস্ট্রি অব রোম–এর ১৭৯ পর্বের সব নিয়ে আলোচনা করার পরিসর আমাদের নেই, তবে সংক্ষেপে রোমান প্রজাতন্ত্র ও সাম্রাজ্যের পতনের দিকে একটু ফিরে দেখা যেতেই পারে।
রোমান রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্রে পতনের সঙ্গে আজকের সময়ের বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভূমধ্যসাগরে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর রোমান প্রজাতন্ত্রের অভ্যন্তরে অতিধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্রুত বাড়তে থাকে। আর সেটাই বিভিন্ন সামাজিক সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়।
ইতালির ভেতরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়—যেখানে স্থানীয় ইতালীয়রা নাগরিকত্ব চেয়ে লড়াই করছিল, যাতে তারা সমাজে অংশ নিতে পারে। অন্যদিকে, পুরোনো রোমান অভিজাত শ্রেণি সেই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই সংঘাত যত তীব্র হতে থাকে, রাজনীতিবিদরা তত বেশি শিষ্টাচার হারিয়ে ফেলে—কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়, সেসব সীমা ভেঙে যায় শুধুই নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য।
প্রশ্নটা হলো—আপনি যদি ভোটে হেরে যান, নির্বাচনে হেরে যান, তখন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান? একসময় একটা সাধারণ ঐকমত্য ছিল যে, হেরে গেলে মেনে নিতে হয়। কিন্তু রোমান দুনিয়ায় রাজনৈতিক নেতা আর সামরিক নেতারা ছিলেন একই ব্যক্তি। ফলে, তাদের হাতে সেনাবাহিনী ছিল, আর তারা সেই সেনাবাহিনীকে একে অপরের বিরুদ্ধে নামাতে শুরু করলেন। এভাবেই প্রজাতন্ত্র ভেঙে পড়ল।
একবিংশ শতকের আমেরিকাতেও আমরা দেখছি সম্পদের বিপুল বৈষম্য, নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব, আর রাজনৈতিক বিদ্রোহ। ২০২১ সালের জানুয়ারির ৬ তারিখে ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনা যেন রোমের রাজনৈতিক পতনের আধুনিক প্রতিধ্বনি। কারণ, ভোটে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে এক বিদ্রোহের চেষ্টাও ছিল এটি।
আর যখন রোমান প্রজাতন্ত্র ভেঙে পড়ে, এরপরেও রোম সাম্রাজ্য ৫০০ বছর টিকে ছিল। তবে প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে রূপান্তরটা হয়েছিল ধীরে ধীরে। অগাস্টাস কখনো ঘোষণা করেননি—"আমি এখন সম্রাট, আর এটাই সাম্রাজ্য।" নির্বাচন ঠিকই অনুষ্ঠিত হত, সিনেটর শ্রেণি বিভিন্ন পদপদবির জন্য তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। এই বাহ্যিক কাঠামো অক্ষত থাকলেও সব ক্ষমতা একক ব্যক্তির হাতে সঞ্চিত হতো।
এমনটা যেন হতো যদি আমেরিকায় একজন প্রেসিডেন্ট একইসঙ্গে হাউস স্পিকার, সিনেট মেজরিটি লিডার, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হন, আর সুপ্রিম কোর্টে তার ভোট অন্য সবার ভোটের চেয়ে বেশি গণ্য করা হয়। এভাবে বাহ্যিকভাবে প্রজাতন্ত্রের ছদ্মবেশ থাকলেও ভেতরে ভেতরে সব ক্ষমতা তাঁর হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়বে।
বাইরের থেকে দেখলে তখনও মনে হবে যেন প্রজাতন্ত্র বিদ্যমান। সুতরাং আমেরিকান সমাজ যদি এই পথেই যায়— তাহলেও তাদের একটি প্রতিনিধি পরিষদ বা কংগ্রস থাকবে, সুপ্রিম কোর্ট থাকবে, একজন প্রেসিডেন্ট থাকবে, গভর্নর থাকবে, নির্বাচন হবে, কিন্তু আসল ব্যাপার হলো সবটাই মরিচিকা, যা নেপথ্যের বাস্তব দৃশ্যকে আড়াল করবে মাত্র। এই ধুম্রজাল কখনো পুরোপুরি উবে যাবে না, আসল ব্যাপারটা গিয়ে দাঁড়াবে বাহ্যিক ওই আস্তরণ কতোটা হয় তার ওপর।
অভিজাত শ্রেণির ভূমিকা
এখানে "এলিট"দের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সম্পদের বৈষম্য যেভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে সমাজের খুব অল্প সংখ্যক মানুষের হাতে অসীম প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ জমা হয়েছে। যে কোনো শাসনব্যবস্থার বৈধতা টিকিয়ে রাখতে হলে এই প্রভাবশালীদের খুশি রাখা জরুরি। তারা যদি সরে যায়, তবে পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়তে পারে।
ইতিহাসে কৃষক বিদ্রোহের নজির অনেক আছে, কিন্তু তা সাধারণত ভেস্তে যায়। কিন্তু যদি এলিট শ্রেণির একটি অংশ বিরোধিতায় নামতে চায়, তখনই প্রকৃত পরিবর্তন ঘটে। যেমন—আমেরিকান বিপ্লবের (স্বাধীনতা সংগ্রামের) প্রতিষ্ঠাতা পিতারা সবাই উপনিবেশের ধনী শ্রেণির লোক ছিলেন। ফরাসি বিপ্লবেও কেবল সাধারণ মানুষ নয়, বরং অভিজাত শ্রেণির একাংশ রাজা ষোড়শ লুইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। রুশ বিপ্লবে এমনকি রোমানভ পরিবারের সদস্যরাও জার দ্বিতীয় নিকোলাসের বিরোধিতা করেছিলেন।
আমেরিকায়ও ৬ জানুয়ারির ঘটনার পর এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল রিপাবলিকান নেতৃত্ব হয়তো ট্রাম্প থেকে সরে আসবে। কিন্তু ট্রাম্প তাদের আবার নিজের দলে টেনে নিলেন। এই ঘটনাই ব্যক্তিপূজার রাজনীতির নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।
ট্রাম্প-পরবর্তী ভবিষ্যৎ
ট্রাম্প মারা গেলে কী হবে? মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন বা মাগা আন্দোলন কি তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে, নাকি অন্য কেউ এসে তার জায়গা নিতে পারবে? ইতিহাস বলছে, ব্যক্তিপূজার আন্দোলনগুলো নেতৃত্বহীন হলে ভেঙে পড়ে। ডানকানও নিশ্চিত নন—ট্রাম্প-পরবর্তী সময়ে কেউ সেই ক্যারিশমা দেখাতে পারবে কিনা।
এমন মোড় ঘোরানো মুহূর্তই ইতিহাসের বাঁক তৈরি করে। তবে মার্কিন সমাজে পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব হবে কিনা, সে বিষয়ে ডানকান সন্দিহান। তার মতে, সব বিপ্লবই শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ন্ত্রণ একেবারেই একতরফা—ডানপন্থী গোষ্ঠীর হাতে অসীম অস্ত্রভাণ্ডার, আর অন্যপক্ষের হাতে কিছুই নেই। ফলে প্রকৃত বিপ্লবের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার অবস্থান
প্রশ্ন উঠছে—যুক্তরাষ্ট্র কি এখনো প্রধান বৈশ্বিক সাম্রাজ্য? নাকি পতন শুরু হয়েছে? ডানকান মনে করেন, আমেরিকার প্রভাবের শীর্ষ বিন্দু ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। সব সাম্রাজ্যই ক্ষণস্থায়ী। বিংশ শতকে যেমন আমেরিকাকে অপরাজেয় মনে হয়েছিল, চলতি শতকে তা আর সম্ভব নয়।
চীন এখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে চাইছে। তবে ডানকানের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পতন মানেই পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু নয়। কারণ চীন যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, শোষণ কিংবা মৃত্যুর অঙ্ক হয়তো মার্কিন সাম্রাজ্যের শাসনকালের সমান, এমনকি তার চেয়েও খারাপ হতে পারে।
তিনি মনে করিয়ে দেন, জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন ইরাকে হস্তক্ষেপ করে আমেরিকার সফট পাওয়ারকে ধ্বংস করেছিলেন। ওবামা এসে সেই ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সময় আমেরিকা বিশ্বমঞ্চে অবিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোনো চুক্তি বা জোটে আর কেউ যুক্তরাষ্ট্রকে ভরসা করতে চাইছে না।
তবুও আমেরিকা এখনও অগাধ সম্পদ ও শক্তির অধিকারী। তাই যতই অস্থির হোক, দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী রয়ে যাবে।
বোকামির রাজনীতি
রোমান সাম্রাজ্যের পতন কি এতটা বোকামি দিয়ে ঘটেছিল? ডানকানের মতে, সম্ভবত না। কারণ তখনকার মানুষ অধিকাংশই নিরক্ষর কৃষক ছিল, তারা জানতোই না কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় কী হচ্ছে। আজকের মতো গণমাধ্যম বা তথ্যপ্রযুক্তি ছিল না। অথচ আজ আমরা প্রতিটি রাজনৈতিক বোকামি রিয়েল-টাইমে প্রত্যক্ষ করি।
তিনি একটি তত্ত্বের কথা বলেন—গ্রেট ইডিয়ট থিওরি অব রেভল্যুশনস । এর মানে হলো, ইতিহাসে বিপ্লব অনেক সময় ঘটে যখন সরকার এতটাই নির্বোধ বা অদক্ষ হয়ে ওঠে যে, সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে ফেলে। দক্ষ সরকার বিদ্রোহ ডেকে আনে না। কিন্তু অদক্ষতা, স্বল্পদৃষ্টি আর অব্যবস্থাপনাই সমাজকে অস্থিরতায় ঠেলে দেয়।
আজকের আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেকটা "কোর্ট ফেভারিট"-এর মতো—যাদের মেধা, যোগ্যতা, দৃষ্টিভঙ্গি নেই, তবুও তারা শাসন করছে। রাজনীতির প্রতিটি স্তরে যদি এমন মানুষ ভরে যায়, তখন রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনিবার্যভাবে ভেঙে পড়ে।
সামনে কী?
আমেরিকা কি ইতিমধ্যেই অনিবার্য পতনের পথে? ডানকান নিশ্চিত নন। তিনি নিজেকে আশাবাদী বলে দাবি করেন। তার মতে, মানুষের সৃজনশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতা বিশাল। ইতিহাসে আমেরিকা অনেক সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এবারও হয়তো পারবে।
তবে তার সতর্কবার্তা স্পষ্ট—হতাশ হওয়া যাবে না। শুধু পরিস্থিতি খারাপ দেখাচ্ছে মানেই তা খারাপভাবে শেষ হবে—এমনটা নয়। সবসময়ই পরিবর্তনের সুযোগ থাকে, আশা রাখার কারণ থাকে।
