সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি: কেন অস্বস্তিতে ভারত?

গত সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ যখন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে আলিঙ্গন করলেন, তা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এই আলিঙ্গনের আগে দু'দেশের মধ্যে একটি 'কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম দেশ পাকিস্তান উপসাগরীয় অঞ্চলের ক্ষমতাধর সৌদি আরবের আরও কাছাকাছি চলে এলো।
সৌদি আরবের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটি শুধু তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি। কিন্তু ভারত এটিকে ভিন্ন চোখে দেখছে। ভারতের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক ভালো হলেও, এই চুক্তি এমন সময় এলো যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুবই সংকটপূর্ণ। এ বছরের শুরুতেও তাদের মধ্যে চার দিনের যুদ্ধ হয়েছে। পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে অনেকবার যুদ্ধ ও সংঘর্ষে জড়িয়েছে। তাই সৌদি আরব যদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে, সেটা ভারতের জন্য সরাসরি উদ্বেগের কারণ।
ভারতীয় বিশ্লেষকদের সবচেয়ে বেশি চিন্তিত করেছে চুক্তির এই কথাটি: 'যেকোনো এক দেশের বিরুদ্ধে হামলা মানে উভয় দেশের বিরুদ্ধে হামলা।'
ভারতীয় কৌশলবিদ ব্রহ্ম চেলানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, 'সৌদি আরব জানত যে ভারত এই চুক্তিকে তাদের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখবে, তবুও তারা এটি করেছে।' তিনি মনে করেন, 'এই চুক্তি পাকিস্তানের দুর্বলতা নয় (কারণ পাকিস্তান এখনও অর্থনৈতিক সংকটে আছে), বরং সৌদি আরবের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে।' চেলানি আরও বলেন, পাকিস্তানের মতো একটি 'নির্ভরশীল' দেশকে পাশে পেয়ে সৌদি আরব যেমন জনবল ও পারমাণবিক 'নিরাপত্তা' পাচ্ছে, তেমনই ভারত, ওয়াশিংটন এবং অন্যদের কাছে প্রমাণ করছে যে তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেবে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবল এই চুক্তিকে সৌদি আরবের 'ভুল পদক্ষেপ' বলেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন যে এর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে। সিবল এক্স-এ লিখেছেন, 'রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পাকিস্তানকে নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে দেখা বিপজ্জনক। সৌদি আরব জানে যে ভারত এটিকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখবে।' তিনি যোগ করেন, 'ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার কারণে সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ কৌশলগতভাবে খুবই সাহসী।'
ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার অবশ্য এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সরকার 'এই চুক্তির জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার উপর কী প্রভাব পড়ে তা খতিয়ে দেখবে।' ভারত আরও আশা করেছে যে তাদের এবং সৌদি আরবের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব 'পারস্পরিক স্বার্থ ও সংবেদনশীলতাকে মাথায় রাখবে।'

তবে সব বিশ্লেষক এই চুক্তিতে আতঙ্কিত নন। তারা বলছেন, ভারত হয়তো ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেখছে। কারণ সৌদি আরব ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। ভারত সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং তেল বিক্রির অন্যতম প্রধান ক্রেতা।
পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান এই চুক্তিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে মানা করেছেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, এটি 'ভারতের সরাসরি কোনো ক্ষতি করবে না।' সৌদি আরবের ভারতের সঙ্গে অনেক গভীর সম্পর্ক আছে, তাই তারা 'ভারতের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কিছু করবে না।'
তবে কুগেলম্যানের মতে, পাকিস্তানকে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যুক্ত করার মাধ্যমে এই চুক্তি 'ভারতের জন্য এক ধরনের কৌশলগত বাধা' তৈরি করেছে। এখন পাকিস্তান চীন, তুরস্ক এবং সৌদি আরব — এই তিনটি শক্তিশালী দেশের সমর্থন পাবে। সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে চীন ও তুরস্ক পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল।
অন্যদের যুক্তি হলো, এই চুক্তির আসল গুরুত্ব ভারতের জন্য তাৎক্ষণিক হুমকিতে নয়, বরং এটি কীভাবে আঞ্চলিক ক্ষমতাগুলোর জোটকে নতুনভাবে সাজাচ্ছে তার ওপর।
হোসেন হাক্কানি, যিনি পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ছিলেন, বিবিসিকে বলেছেন যে ভারতের উদ্বেগ 'অনেক দিক থেকে।' তিনি সতর্ক করে বলেছেন যে এই চুক্তি সৌদি আরবকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে তুলতে পারে। অর্থাৎ, সৌদি আরব অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে পারে।
হাক্কানি আরও উল্লেখ করেন, এই চুক্তি কীভাবে 'আগ্রাসন' এবং 'আগ্রাসী' কে সংজ্ঞায়িত করে এবং সৌদি আরব ও পাকিস্তান এ বিষয়ে একমত হয় কিনা তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তিনি আরও সতর্ক করেছেন যে এটি সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের কষ্টার্জিত অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
তবে সবাই এই চুক্তিকে বিশাল পরিবর্তনের কারণ হিসেবে দেখছেন না। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েস্ট এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের মো. মুদ্দাসির কোয়ামার বলেন, 'এই চুক্তিটি আসলে ১৯৬০ এর দশক থেকে চলে আসা সৌদি-পাকিস্তান বোঝাপড়ার একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মাত্র।'
আসলেই, দুটি দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী বন্ধন রয়েছে। ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানি সেনারা সৌদি আরবে মোতায়েন ছিল, এমনকি ১৯৭৯ সালে মক্কা মসজিদের অবরোধ দমনেও কমান্ডো পাঠিয়েছিল। এরপর থেকে সৌদি আরব পাকিস্তানের কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছে, নিজেদের বিমান বাহিনী গড়তে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর করেছে এবং পাকিস্তানকে একটি আদর্শিক মিত্র ও নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে গড়ে তুলেছে। ২০১৭ সালে সৌদি আরব অবসরপ্রাপ্ত একজন পাকিস্তানি সেনাপ্রধানকে তাদের আইএসআইএস-বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিল।
হাক্কানি আরও বলেন, '১৯৭০ এর দশক থেকে সৌদি আরব সব সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তারা পাকিস্তানের পাশে ছিল, সংকটের সময় অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়েছে, তেলের অর্থ পরিশোধে ছাড় দিয়েছে এবং একটি ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।'
কেন এখন এই চুক্তি?
দীর্ঘদিনের এই জোটের বাইরেও বিশেষজ্ঞরা একটি বড় কারণের দিকে ইঙ্গিত করছেন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রদানের সক্ষমতা নিয়ে বিশ্বাস কমে যাওয়া। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো সন্দেহ করছে যে সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষা করতে পারবে কিনা। সম্প্রতি ইসরায়েলের আক্রমণ, যা কাতার এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে চিন্তিত করেছে, রিয়াদের সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ওয়াশিংটনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

চ্যাথাম হাউসের আহমেদ আবুদু বলেছেন, এই চুক্তিটি যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য জানানোর জন্য বেশি। তিনি বিবিসিকে বলেন, 'এটি এই বার্তা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে যে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বজায় রেখেও নিজেদের নিরাপত্তা অংশীদারিত্বে বৈচিত্র্য আনছে।'
তিনি আরও বলেন, 'যদিও এই চুক্তির কার্যকারিতা কতটা গভীর হবে তা স্পষ্ট নয়, তবে এটি সৌদি আরবের হুমকির ধারণায় একটি পরিবর্তন নির্দেশ করে। তারা এখন ইরান এবং ইসরায়েল উভয়কেই হুমকি হিসেবে দেখছে এবং পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তির সুবিধা নিয়ে নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।'
ভারতের জন্য কী প্রভাব?
ভারতের জন্য এই চুক্তির বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে। আবুদু বলেছেন, প্রতিরক্ষা দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আসল ঝুঁকি, তিনি বিবিসিকে বলেন, অন্য কোথাও নিহিত: একটি বিস্তৃত জোট 'ইসলামিক ন্যাটো'-তে পরিণত হতে পারে। এটি উপসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং কৌশলগত করিডোরের জন্য দিল্লির 'লুক ওয়েস্ট' কৌশলকে জটিল করে তুলবে।
আবুদুর মতে, পাকিস্তানের জন্য এই চুক্তি সৌদি আরবের আর্থিক শক্তি ব্যবহার করে সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে এবং রাজনৈতিক সমর্থন পেতে সাহায্য করবে। ফলে ভারতকে কেবল পাকিস্তানের নয়, মুসলিম দেশগুলোর একটি বড় জোটের মুখোমুখি হতে হবে।
কুগেলম্যান বলেছেন, এই চুক্তি আঞ্চলিক ভারসাম্যকে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে। ভারত, যারা আনুষ্ঠানিক জোট এড়িয়ে চলে এবং যাদের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আবারও খারাপ হয়েছে, তাদের নতুন করে নিজেদের কৌশল সাজাতে হবে। তিনি যোগ করেন, 'ভারত অবশ্যই রাশিয়া, ইসরায়েল, উপসাগরীয় রাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের মতো প্রধান পশ্চিমা অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উপর নির্ভর করতে পারে। কিন্তু বিষয়টি ভারতের দুর্বলতার চেয়ে পাকিস্তানের শক্তির বৃদ্ধি নিয়ে বেশি।'
যদিও এই চুক্তি ভারতের জন্য কোনো তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা হুমকি নাও হতে পারে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে কূটনৈতিকভাবে এটি ভারতের জন্য ভালো খবর নয়। শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল কী হয়, তা দেখার জন্য দিল্লি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।