ব্যতিক্রমী গবেষণার স্বীকৃতি দিতে ফিরল ইগ নোবেল পুরস্কার
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, একটি গরুকে জেব্রার মতো ডোরাকাটা রঙ করলে মাছি বা পোকামাকড়ের কামড় থেকে মুক্তি মিলবে কিনা? কিংবা কোন ধরনের টিকটিকি কোন পিৎজার টপিংস বেশি পছন্দ করে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও, বিজ্ঞানীরা এসব নিয়েও গবেষণা করেছেন। আর সেসব ব্যতিক্রমী গবেষণার স্বীকৃতি দিতেই এ বছরের ইগ নোবেল পুরস্কারের জমকালো অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার [বোস্টন সময়] যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, 'অ্যানালস অফ ইমপ্রোবাবেল রিসার্চ' ম্যাগাজিনের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটি ছিল ইগ নোবেলের ৩৫তম আসর। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারও করা হয়।
প্রথা অনুযায়ী, ইগ নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় সেইসব গবেষণাকে, যা প্রথমে মানুষকে হাসায়, পরে ভাবতে বাধ্য করে। ঐতিহ্য অনুযায়ী এবারও দর্শকরা পুরস্কারজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন কাগজের তৈরি বিমান ছুড়ে।
এবারের মূল থিম ছিল 'পরিপাক'। অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে ছিলেন ড. ট্রিশা পাসরিচা, যিনি টয়লেটে বসে স্মার্টফোন ব্যবহার করা থেকে কীভাবে হেমোরয়েডস (পাইলস) হতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। এছাড়া, মঞ্চে পরিবেশিত হয় একটি ছোট অপেরা—'দ্য প্লাইট অব দ্য গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট'। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, প্রকৃত নোবেল বিজয়ীরাই এই মজার পুরস্কারগুলো প্রদান করেন।
গরুর গায়ে জেব্রার ডোরা অঙ্কণকারী এবং টিকটিকিকে পিৎজা খাওয়ানোর গবেষকদল ছাড়াও মঞ্চে অন্য পুরস্কারজয়ীরাও ছিলেন। যেমন, উইলিয়াম বি. বিনকে (মরণোত্তর) সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। একটি নখের ৩৫ বছরের বৃদ্ধি তিনি নিয়মিতভাবে নথিভুক্ত ও বিশ্লেষণ করেছিলেন।
আবার জুলি মেনেলা ও গ্যারি বোশাম্প মায়েরা রসুন খেলে তাদের স্তন্যপানকারী শিশুদের অভিজ্ঞতা কীভাবে ভিন্ন হয় তা নিয়ে গবেষণার জন্য পেয়েছেন শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক পুরস্কার।
মনোবিজ্ঞানে পুরস্কার পেয়েছেন মারসিন জায়েনকভস্কি ও জিল গিগনাক। তারা গবেষণা করেছেন, কোনো আত্মপ্রেমী (নার্সিসিস্ট) মানুষকে যদি বলা হয় যে তিনি বুদ্ধিমান, তখন তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়।
এদিকে, রসায়নে পুরস্কারপ্রাপ্ত রটেম নাফতালোভিচ, ড্যানিয়েল নাফতালোভিচ এবং ফ্রাঙ্ক গ্রিনওয়ে রান্নার পাত্রে ব্যবহৃত টেফলন খেয়ে পরীক্ষা করেন, এটি অতিরিক্ত ক্যালোরি যোগ না করেই খাদ্যের পরিমাণ ও তৃপ্তি বাড়াতে পারে কিনা।
এছাড়া, ফ্রিৎস রেনার, ইনগে কার্সবার্গেন, ম্যাট ফিল্ড ও জেসিকা ভেরথম্যান পরীক্ষা করেছেন—মদ্যপান করলে মানুষ বিদেশি ভাষায় কথোপকথনে বেশি দক্ষ হয় কিনা সেটি নিয়ে। অন্যদিকে, বিকাশ কুমার এবং সার্থক মিত্তাল প্রকৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করে দেখেন যে দুর্গন্ধযুক্ত জুতা কীভাবে জুতার র্যাকে সাজানোর ভালো অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে।
বিমান চলাচল বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন ফ্রান্সিসকো সানচেজ, মারিয়ানা মেলকন, কারমি কোরিনে ও বেরি পিনশো—তারা গবেষণা করেছেন, বাদুড় মদ্যপান করলে তার ওড়ার ও প্রতিধ্বনি শনাক্ত করার ক্ষমতায় কী প্রভাব পড়ে। আর পদার্থবিদ্যায় পুরস্কার দেওয়া হয় একটি দলকে, যারা পাস্তা সসের পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন, বিশেষ করে এটি দলা হয়ে যাওয়া প্রতিরোধের উপায় নিয়ে।
লেনোয়ার-রাইন ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক কার্লি ইয়র্ক জানান, এবারের বিজয়ীরা সত্যিই হাসির মাধ্যমে চিন্তার জন্ম দিয়েছেন।
ইয়র্ক বলেন, 'আপাতদৃষ্টিতে উদ্ভট মনে হওয়া প্রতিটি গবেষণার আড়ালেই লুকিয়ে আছে বাস্তব জ্ঞান।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি এই গবেষণার মূল্য আপনার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট না হয়, তবে মনে রাখবেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধুমাত্র কৌতূহল দ্বারা পরিচালিত বিজ্ঞানীদের অবদান থেকে এসেছে।'
ইয়র্কের মতে, 'মূলত কৌতূহলকে কেন্দ্র করে হওয়া মৌলিক গবেষণার মাধ্যমেই বিগত শতকে সবচেয়ে যুগান্তকারী চিকিৎসা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। যেমন, ডিএনএ সিকোয়েন্স করার প্রযুক্তি এসেছে ব্যাকটেরিয়া কীভাবে তীব্র উত্তাপে বেঁচে থাকে, তা গবেষণা করার মাধ্যমে।'
ইয়র্ক আরও বলেন, 'এই ধরনের মৌলিক গবেষণা প্রায়শই উপেক্ষিত হয়, কারণ সবাই তাৎক্ষণিক ফল দেবে এমন প্রকল্পের দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে। বর্তমানে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম মৌলিক বিজ্ঞান সমর্থক) সরকারি বাজেট কমানোর ফলে আমরা এই প্রবণতা আরও বেশি দেখছি।'
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'কিন্তু এই কাজগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মৌলিক গবেষণা জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করে, যা ভবিষ্যতের বড় আবিষ্কারগুলোকে সম্ভব করে তোলে।'
আর হ্যাঁ, যারা ভাবছেন, গবেষণার ফল কী হলো—জেব্রার মতো ডোরা কাটা গরু ঘোড়ামাছির কামড়ে পড়ার ঝুঁকি প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়েছে। আর টোগোর একটি রিসোর্টে রঙিন টিকটিকিরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে 'ফোর-চিজ পিৎজা'।
