শুল্কবিরোধ অবসানে ট্রাম্প-মোদির আশাবাদ বনাম ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা

যখনই কোনো উপলক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করমর্দন করেন, "অসীম সম্ভাবনা"র কথা বলেন এবং তাঁদের বন্ধুত্বকে অভূতপূর্ব শক্তিশালী হিসেবে ঘোষণা করেন—দৃশ্যত মনে হয় বিশ্ব শিগগিরই এক ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তির সাক্ষী হতে যাচ্ছে।
তাদের এই আশাবাদী প্রদর্শনের পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। ট্রাম্প, যিনি নিজেকে সবসময় "দারুণ ডিলমেকার" হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তিনি জানেন আলোচনার মাটির নিচে কঠিন শিলাস্তর থাকলেও— বাহ্যিক আত্মবিশ্বাসের প্রদর্শন রাজনৈতিকভাবে জরুরি। অন্যদিকে, মোদির জন্য ভারতের "উদীয়মান শক্তি"র ইমেজ ধরে রাখা অপরিহার্য। আর তা প্রমাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও অংশীদারত্ব অত্যন্ত দরকারি—যা বিশ্বব্যবস্থায় দিল্লিকে অপরিহার্য খেলোয়াড় হিসেবে তুলে ধরে।
কিন্তু সৌহার্দ্যপূর্ণ কথার আড়ালে রয়ে গেছে তীব্র মতভেদ। শুল্কনীতি, নিষেধাজ্ঞা আর পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভবিষ্যতের ওপর গভীরতর ছায়া ফেলছে। ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র "শুল্ক কূটনীতি" দ্বিগুণ জোরে ব্যবহার করছে। ভারতীয় আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
এসব শাস্তিমূলক পদক্ষেপ সরাসরি যুক্ত ভারত-রাশিয়া বাণিজ্যের সঙ্গে। ট্রাম্পের কাছে এটি কেবল বাণিজ্য ঘাটতির প্রশ্ন নয়—এটি ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে মস্কোকে অর্থনৈতিকভাবে শ্বাসরোধ করারও অংশ।
মোদির জন্য বিষয়টি ভিন্ন। ভারতের দীর্ঘদিনের "কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন" নীতি হলো বৈশ্বিক রাজনীতিতে স্বাধীন থাকা। যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক চাপ সেই ভারসাম্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে।
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ও রাশিয়ার ছায়া
ভারতের এই অবস্থান ঐতিহাসিক। স্বাধীনতার পর নেহরুর নেতৃত্বে ভারত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়ন দেশগুলোর "জোট-নিরপক্ষে আন্দোলন"- যুক্ত হয়, কিন্তু বাস্তবে দিল্লি মস্কোরই আরও ঘনিষ্ঠ হয়—অস্ত্র, জ্বালানি ও কূটনৈতিক সমর্থনের জন্য। সেই উত্তরাধিকার আজও ভারতের নীতিকে প্রভাবিত করছে।
বর্তমানে রাশিয়া থেকে ছাড়কৃত দামে তেল ক্রয় ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির রসদ জোগাচ্ছে এবং মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে। ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান—ভারতের সামরিক বাহিনীর মেরুদণ্ড আজও রাশিয়ান অস্ত্র। সেখানে হঠাৎ করে মস্কোর হাত ছেড়ে দেওয়া মানে অর্থনৈতিক চাপ তো বটেই, এমনকী চীনকে ঘিরে দিল্লির নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগও প্রবল হয়ে উঠবে।
সুতরাং ট্রাম্পের শুল্ক-হাতুড়ি ভারতকে ভাঙতে পারবে এমন ধারণা ভুল। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত ছোটখাটো রাষ্ট্র নয় যে সহজে চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে। তাই দিল্লি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের নীতি মেনে ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে, আবার মস্কোর ওপরও নির্ভর করছে জ্বালানি ও অস্ত্রের জন্য।
ইতিহাসও মনে করিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকলেও মস্কো ভারতের কূটনৈতিক ভরসা হয়ে দাঁড়ায়, জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে দিল্লিকে একঘরে হতে দেয়নি। পাকিস্তান ভাঙায় মস্কোর অভূতপূর্ব সমর্থনের সেই অভিজ্ঞতা ভারতীয় রাষ্ট্রনায়কদের স্মৃতিতে আজও অম্লাণ। তাই ভারতের কূটনীতিক এস্টাব্লিশমেন্টের কাছে মস্কোর গুরুত্বও ঐতিহাসিক এক বাস্তবতা। মোদি সরকারের গত এক দশকের আমেরিকামুখী কূটনীতির সম্প্রসারণে যা এতদিন চাপা পড়েছিল।
ট্রাম্পের শুল্ক ঝুঁকি
সমস্যা আরও গভীর হয়েছে ট্রাম্পের সার্বজনীন শুল্কনীতির কারণে। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আহ্বান করেছেন চীন ও ভারতের পণ্যে ১০০% শুল্ক বসাতে। যুক্তি—এভাবে রাশিয়ার অর্থনৈতিক রসদ কেটে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সাহসী পরিকল্পনা সবসময় প্রজ্ঞার সমার্থক নয়। ভারতকে চীনের সমতুল্য শত্রু হিসেবে দেখানো একদিকে ভুল বার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে এশিয়ায় ওয়াশিংটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেই দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
ভ্লাদিমির পুতিন এ সুযোগ হাতছাড়া করেননি। তিনি বলেছেন, ভারত ও চীনের সঙ্গে "ঔপনিবেশিক ভঙ্গিতে" কথা বলা গ্রহণযোগ্য নয়। ঔপনিবেশিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ভারত যেকোনো বশ্যতা শিকারের আহ্বান বা চাপকে সংবেদনশীলভাবে নেয়। ট্রাম্পের হুমকি সেই ক্ষতকে উসকে দিচ্ছে। এতে রাশিয়া ও চীনের কূটনৈতিক বয়ান আরও শক্তিশালী হচ্ছে যে, পশ্চিম আসলে আধিপত্য চায়, অংশীদারত্ব নয়।
ফলত, ট্রাম্পের উচ্চশুল্ক কৌশল উল্টো ফলও দিতে পারে। দিল্লিকে মস্কো ও বেইজিংয়ের কাছ থেকে সরানোর বদলে হয়তো আরও কাছে ঠেলে দেবে। বাণিজ্য দিয়ে চাপ তৈরি দ্রুত ফল আনতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি আস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে না।
প্রতীক বনাম বাস্তবতা
তবে এর মানে এই নয় যে ট্রাম্প ও মোদি কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবেন না। দুজনই প্রতীকী বিজয়কে প্রকৃত অচলাবস্থার আড়ালে ব্যবহার করতে সিদ্ধহস্ত। মোদির কাছে সবচেয়ে জরুরি হলো ঘরোয়া রাজনীতিতে শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠা— এটাই দেখানো যে, তিনি বিদেশি চাপে নতি স্বীকার করেননি। ট্রাম্পের অগ্রাধিকার ভিন্ন—তাঁর দরকার এমন একটি চুক্তি, যা তিনি প্রচারণায় নিজের কৃতিত্ব হিসেবে দেখাতে পারবেন।
ফলে সর্বাত্মক বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং ছোট ছোট কিছু সমঝোতা হতে পারে—মার্কিন প্রাকৃতিক গ্যাস কেনা, মার্কিন কোম্পানির জন্য কৃষি ও ডিজিটাল খাতে বাজার খোলা, কিংবা সীমিত প্রতিরক্ষা যৌথ উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
এতে মৌলিক দ্বন্দ্ব—যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞানির্ভর বাণিজ্যনীতি বনাম ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন—সমাধান হবে না। তবে উভয়পক্ষ অন্তত প্রতীকী জয় দেখাতে পারবে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
ট্রাম্প-মোদির এই নৃত্য আজকের বিশ্বব্যবস্থার ভঙ্গুরতা স্পষ্ট করে। একসময় বাণিজ্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ত, এখন তা অস্ত্র হয়ে উঠছে। জোটগুলোও আর শুধু মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে নেই; বরং প্রয়োজনে গড়ে ওঠা চুক্তি, চাপ ও দরকষাকষির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
ভারত এ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি—রাশিয়ার দিকে তাকায় জ্বালানির জন্য, পশ্চিমের দিকে রপ্তানি বাজারের জন্য, আর নিজের দিকে নিরাপত্তার জন্য। সর্বোচ্চ লক্ষ্য— সবপক্ষের থেকে স্বাধীন থাকা।
এই অবস্থায়, সর্বোচ্চ হলে ওয়াশিংটন-দিল্লি এক অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে পারে। এতে ভাঙন ঠেকবে, কিন্তু মৌলিক দ্বন্দ্ব মিটবে না। ট্রাম্প শুল্ক দিয়ে রাশিয়াকে শ্বাসরোধ করতে চান, এদিকে মোদিও কৌশলগত স্বকীয়তা রক্ষায় মনোযোগী। আর পুতিন দিল্লি-ওয়াশিংটনের এই ব্যবধানকে কাজে লাগাতে প্রস্তুত।
ফলে একটি ক্ষুদ্র চুক্তিও যদি হয়, ট্রাম্প ও মোদি দুজনই তাকে ঐতিহাসিক আখ্যা দেবেন। কিন্তু যদি তা ভেঙে পড়ে, তার অভিঘাত শুধু ওয়াশিংটন-দিল্লি নয়, সমগ্র পশ্চিমা শিবিরে পড়বে। আমেরিকার শুল্ক-চালিত কূটনীতির সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হবে এবং ভারতকে আরও দৃঢ়ভাবে তার স্বাধীন কৌশলগত পথে চলার দিকে ঠেলে দেবে।
লেখক: এম এ হোসেন একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির বিশ্লেষক। তার লেখা প্রকাশিত হয় সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, জাকার্তা পোস্ট, এশিয়ান এজ, কোরিয়া টাইমস, নিউ এজ, মডার্ন ডিপ্লোমেসি, দ্য জিওপলিটিকস, সাউথ এশিয়া মনিটর এবং দ্য ডেইলি গার্ডিয়ান-সহ বিখ্যাত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।