তীব্র গরম ধূমপান ও মদ্যপানের মতোই ক্ষতিকর, বাড়ায় বয়সও

ফিনিক্স, হিউস্টন কিংবা মায়ামির মতো শহরে তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে ওঠে। এসব অঞ্চলে যারা বসবাস করেন তারা শুধু ঘামেই ভিজে কষ্ট পান না, বরং ঠান্ডা অঞ্চলে বসবাসকারীদের তুলনায় দ্রুত বার্ধক্যের মুখোমুখি হচ্ছেন।
সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে, অনেকদিন ধরে তীব্র গরমে থাকলে শরীরের কোষীয় স্তরে জৈবিক বার্ধক্য বাড়তে পারে। এমনকি এর প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে ধূমপান বা অতিরিক্ত মদ্যপানের মতো ক্ষতিকর হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লিওনার্ড ডেভিস স্কুল অব জেরোন্টোলজির একজন বিশেষজ্ঞ ইউন ইয়ং চোই জানান, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তীব্র গরম এলাকায় বসবাস করেন তাদের জৈবিক বয়স ঠান্ডা অঞ্চলের মানুষের তুলনায় গড়ে ১৪ মাস বেশি। এক্ষেত্রে মানুষের আয়, জীবনধারা বা স্বাস্থ্যগত অবস্থার মতো বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার পরও গবেষণার ফলাফল একই রকম ছিল।
তবে গরম শুধু আয়ুষ্কাল কমাচ্ছে না, বরং জীবনের মান কমিয়ে দিচ্ছে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। কারণ গরমের সময় শরীরকে ঠান্ডা রাখার জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হয়।
যেমন, হৃদ্যন্ত্রকে ত্বকের দিকে রক্ত প্রবাহিত করে তাপ বের করে দিতে বেশ পরিশ্রম করতে হয়, ফলে হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়। স্নায়ুতন্ত্র অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে মাথা ঘোরা, বিভ্রান্তি বা স্মৃতিভ্রংশের মতো উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। কিডনি পানির ঘাটতি সামাল দিতে গিয়ে অতিরিক্ত চাপে পড়ে, ফলে পানিশূন্যতা ও কিডনির ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে। ইমিউন সিস্টেম শরীরে প্রদাহ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ছড়িয়ে দেয়।
মায়ামি কার্ডিয়াক অ্যান্ড ভাসকুলার ইনস্টিটিউটের আদেদাপো ইলুইওমাডে বলেন, 'এটা অনেকটা গাড়ির ইঞ্জিনের মতো, যেটি সবসময় অতিরিক্ত গরম থাকলে একসময় সেই ধকল যন্ত্রাংশগুলোকে স্বাভাবিক সময়ের আগেই নষ্ট করে দেয়।'
অতিরিক্ত তাপমাত্রা আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতি করার পাশাপাশি জিনের কার্যকারিতাকেও পরিবর্তন করে। দীর্ঘ সময় ধরে গরমে থাকার ফলে শরীর জৈবিক চাপের মুখে পড়ে, যা প্রদাহ, অক্সিডেটিভ ক্ষতি ও হরমোনের অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ বয়স বৃদ্ধি পায়। যা অনেক সময় ক্যালেন্ডারের বয়সের চেয়েও দ্রুত ঘটে।
নিউইয়র্কের নর্থওয়েল হেলথের পারিবারিক চিকিৎসা বিভাগের প্রধান এবং প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ তোচি ইরোকু-মালাইজ বলেন, 'শরীর সামান্য চাপের মধ্যে থাকলে সাধারণত মানিয়ে নেয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু বারবার গরমে থাকার মতো দীর্ঘস্থায়ী চাপ শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।'
এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় ৯০০-এর বেশি প্রাপ্তবয়স্কের রক্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- যারা মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর বেশি গড় তাপমাত্রায় ছিলেন, দেখা গেছে তাদের রক্তকণিকা জৈবিকভাবে বয়সে বেশি। উষ্ণ অঞ্চলে শুধু হিটস্ট্রোক বা পানিশূন্যতা নয়, দীর্ঘমেয়াদে বয়সজনিত নানা সমস্যার ঝুঁকিও বাড়তে পারে।'
তবে কিছু গবেষকরা মনে করেন, এসব গবেষণা আকর্ষণীয় হলেও এগুলো পর্যবেক্ষণমূলক। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে একমাত্র গরমই এসব পরিবর্তনের কারণ। তবে গরমের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে এটা বলা যায়।'
গবেষক চোই বলেন, 'যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম গরম ও শুষ্ক অঞ্চলে বাস করছেন, তারা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু তবুও দেখা যায়, অতিরিক্ত গরমের সময় এসব অঞ্চলেও ডিমেনশিয়া ও হৃদ্রোগজনিত মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এটি প্রমাণ করে খাপ খাওয়ানোরও একটা সীমা আছে।'
তবে ভালো খবর হলো- গরমের ক্ষতিকর প্রভাব অবশ্যম্ভাবী নয়। বিশেষ করে তাপপ্রবণ অঞ্চলে বসবাস করলে কিছুটা গরম এড়ানো কঠিন হলেও সচেতন হলে এবং পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
বিশেষজ্ঞ আদেদাপো ইলুইওমাডে বলেন, 'তীব্র গরম অঞ্চলে এয়ার কন্ডিশনিং কোনো বিলাসিতা নয়, এটি স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য উপাদান। বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।'
গরম এড়াতে সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরি। বিশেষজ্ঞ ওয়েনলি নি পরামর্শ দেন, 'সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে বাইরে যাওয়া এড়িয়ে চলুন। ছায়াযুক্ত জায়গায় থাকুন, টুপি ব্যবহার করুন এবং শরীরকে বাইরে গরম পরিবেশ থেকে দূরে রাখুন। এসময়ে পানিশূন্যতা ঠেকানোও সমান জরুরি।'
এ সময়টাতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে বয়স্ক, শিশু ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। তাই তাদের জন্য সামাজিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চোই জোর দিয়ে বলেন, 'যদিও গবেষণায় আমরা দেখছি, তীব্র গরম বার্ধক্য ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে এর ফলাফল স্থায়ী। ভালো পরিকল্পনা, শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন, এবং দৈনন্দিন অভ্যাসে ঠান্ডা পরিবেশ নিশ্চিত করা ও পানির গুরুত্ব বাড়ালেই সবাইকে ভালো ও সুস্থ্য রাখা সম্ভব।'