আফগানিস্তানে ভূমিকম্প: এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে

পাকিস্তান সীমান্তের কাছে পূর্ব আফগানিস্তানে রোববার গভীর রাতে ৬.০ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এতে নানগারহার ও কুনার প্রদেশসহ আশপাশের এলাকায় অন্তত ৮০০ জনের বেশি নিহত এবং আড়াই হাজারের বেশি আহত হয়েছেন, খবর বিবিসি।
ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল নানগারহার প্রদেশের জালালাবাদ শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরপূর্বে। এর গভীরতা ছিল মাত্র ৮ কিলোমিটার। অগভীর ভূমিকম্পে সাধারণত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়।
উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া তালেবান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা বিবিসিকে বলেন, কয়েকটি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
প্রাথমিক ভূমিকম্পের পরে বেশ কয়েকটি বড় পরাঘাত অনুভূত হয়েছে। এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভূমিকম্প-কবলিত অঞ্চল থেকে এখনও তথ্য আসছে, এবং ক্ষতির পরিমাণ ও মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা জানা কিছুটা সময় সাপেক্ষ।
এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য জানা গেছে
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের নানগারহার ও কুনার প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এবং বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
এই পাহাড়ি এলাকাগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থাতেও যাতায়াত অত্যন্ত কঠিন। ফলে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে বড় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভূমিকম্পে ৮০০-এর বেশি মানুষ নিহত হতে পারেন। তবে মন্ত্রণালয় সতর্ক করেছে, এখনও স্পষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা জানা যায়নি।
বিবিসিকে জানানো হয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের দিকে যাওয়ার সড়ক ভূমিধসের কারণে বন্ধ। তাই তালেবান সরকার হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে।

সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, অনেকগুলো ঘর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহায়তা চাওয়া হয়েছে এবং কয়েকটি দেশ সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সড়কপথে যাতায়াত এখনো বন্ধ। তবে ইউনিসেফের কর্মকর্তা সলাম আল জানাবি জানিয়েছেন, শতাধিক বাড়ি ধ্বংস হতে পারে।
কুনার প্রদেশের চাওকি ও নুরগাল এলাকার পুরো গ্রামগুলো সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে সাহায্যসংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন। কাদামাটির ও কাঠের তৈরি বাড়িগুলো ভেঙে পড়ায় বাসিন্দারা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন।
অনেক মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা ছিলেন এবং উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষা করার সময় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
নুরগালের এক কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর অনেক বাসিন্দা সম্প্রতি ইরান ও পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। উভয় দেশই এক মিলিয়নের বেশি আফগানকে প্রত্যাবাসন করার চেষ্টা বাড়িয়েছে—যাদের অনেকেই পূর্বে সহিংসতা থেকে বাঁচতে দেশ ছাড়েছিলেন।
সোমবারের বন্যার পর এই ভূমিকম্প ঘটেছে, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
সংবাদ আসতে দেরি হওয়ার কারণ
ভূমিকম্প-কবলিত অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান জটিল এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত। তাই পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সময়সাপেক্ষ। অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আক্রান্ত এলাকায় পৌঁছানো আরও কঠিন।
পূর্বের বড় ভূমিকম্পে দেখা গেছে, যখনই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে, নিহতের সংখ্যাও দ্রুত বেড়েছে।
তবে আরও কিছু কারণে সঠিক তথ্য পাওয়া এবং সাহায্য পৌঁছানো কঠিন হচ্ছে।

২০২১ সালের আগস্ট থেকে দেশটি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। তাদের সরকারকে বিশ্বের অনেক দেশ স্বীকৃতি দেয়নি।
কঠোর ইসলামপন্থী দলটি ক্ষমতায় ফিরে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের দেশের বাইরে চলে যেতে বাধ্য করেছে। ফলে বিবিসি ও অন্যান্য সংবাদসংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
কিছু সাহায্যসংস্থা ও এনজিওও আফগানিস্তানে তাদের কাজ স্থগিত করেছে, ফলে সেখানে যা ঘটছে তা যাচাই করার উপায় কমে গেছে।
তবে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাঠাতে কোনো বাধা নেই।
আফগানিস্তান কি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে?
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তান অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। আন্তর্জাতিক রেসকিউ কমিটির তথ্য অনুযায়ী, এখন ২৩ মিলিয়নের বেশি আফগানের মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন।
আফগানিস্তানে প্রায় সব বিদেশি অনুদান স্থগিত রয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে তালেবান প্রথম ক্ষমতায় আসার সময় থেকে যেসব আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আছে, তা এখনও চলছে—যদিও মানবিক সাহায্যের জন্য কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে।
তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে আফগানিস্তানের বাজেটের প্রায় ৮০% আসত বিদেশি অনুদান থেকে। এটি দিয়ে প্রায় সব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা চলত, যা এখন ধসে গেছে।

ভূমিকম্পের কেন্দ্রের কাছে অবস্থিত সবচেয়ে বড় হাসপাতাল জালালাবাদের প্রধান হাসপাতাল। সেটি বর্ওতমানে আহত রোগী দিয়ে ভরে গেছে। এই এলাকাতেই পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবাসিত লক্ষাধিক আফগান বসবাস করছেন।
আফগানিস্তানের বিদেশে থাকা আর্থিক সম্পদ (প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) ফ্রিজ করা হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের শুরুতে ইউএসএআইডির সাহায্য স্থগিত হওয়ায় মানবিক সহায়তাও প্রভাবিত হয়েছে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনর্নির্মাণ করতে অনেক বছর লাগতে পারে। পশ্চিম হেরাত প্রদেশের অনেক গ্রাম এখনও প্রায় দুই বছর আগে হওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
নারী ও কিশোরীরা কেন বেশি ঝুঁকিতে?
তালেবান সরকারের বিধিনিষেধের কারণে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা কেয়ার-এর আফগানিস্তান শাখার প্রধান গ্রাহাম ড্যাভিসন বলেন, 'তাদের জীবনের জন্য জরুরি সেবা সীমিত থাকায়, ভূমিকম্পের পর নারী ও কিশোরীরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে।'
কুনার একটি খুবই রক্ষণশীল এলাকা। তাই সাংস্কৃতিক কারণে অনেক সময় নারীদের চিকিৎসা দেরিতে হয়। কিছু নারীর পরিবার রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে, অথবা দিনের আলো ফটার আগ পর্যন্ত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারে।

২০২২ সালে পাকতিকা প্রদেশে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর হাসপাতালে আহত নারীর সংখ্যা দুই দিন পরে বেড়েছিল।
এছাড়া, উদ্ধারকাজে কোনো নারী কর্মী না থাকার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য।
কেন আফগানিস্তান এত ভূমিকম্পপ্রবণ?
আফগানিস্তান অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ। কারণ দেশটি ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে বেশ কয়েকটি ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত।
২০২২ সালে পূর্ব আফগানিস্তানে ৫.৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে অন্তত ১ হাজার মানুষ নিহত এবং ৩ হাজার আহত হন। এটি গত দুই দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
সেই ভূমিকম্প মাঝারি মাত্রার হলেও ভূপৃষ্ঠের মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে সংঘটিত হওয়ায় অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ছিল।
রোববারের ভূমিকম্পটির গভীরতা আরও কম, মাত্র ৮ কিলোমিটার। এ কারণে শত শত মানুষের হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ওই ঘটনায় অন্তত ৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। তবে জাতিসংঘ মৃতের সংখ্যা অনেক কম, প্রায় ১ হাজার ৫০০ বলে জানিয়েছিল।
আফগানিস্তানের বাসিন্দারা ভূমিকম্পের সময় বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ দেশটির ভবনগুলো কাঠ, কাঁচা ইট বা দুর্বল কংক্রিট দিয়ে তৈরি, যা সাধারণত ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়।
আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিকম্পে সৃষ্ট ভূমিধসও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। ধসে ঘরবাড়ি চাপা পড়ে, আবার নদীর প্রবাহও অনেক সময় আটকে যায়।
ভূমিধসের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে দূরবর্তী এলাকায় উদ্ধারকর্মী ও সরঞ্জাম পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ে।
উদ্ধার কাজ আরও কঠিন হয়ে ওঠে বৃষ্টি, তুষার, কুয়াশা এবং তীব্র শীতের মতো প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে।