গোয়ালন্দে ‘ইমাম মাহদি’ দাবিকারী নুরাল পাগলার ‘লাশে অগ্নিসংযোগ’, নিহত ১, আহত শতাধিক
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নিজেকে 'ইমাম মাহদি' দাবিকারী নুরুল হক মোল্লা ওরফে নুরাল পাগলার লাশ শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়েছে উত্তেজিত জনতা। এ সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছে।
নিহত মো. রাসেল মোল্লা (২৮) রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দেবগ্রাম ইউনিয়ন পূর্ব তেনাপচা জুট মিস্ত্রি পাড়ার মো. আজাদ মেম্বারের ছেলে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মো. শরীফ ইসলাম।
জানা যায়, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার বাসিন্দা নুরাল পাগলা নিজেকে ইমাম মাহদি দাবি করতেন। সম্প্রতি তার মৃত্যুর পর ভিন্নরীতিতে তাকে তার কবর দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ওই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর উত্তেজিত জনতা নুরাল পাগলার আস্তানায় হামলা করে। এসময় পুলিশের দুটি ও ইউএনও'র একটি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং মাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় নুরাল পাগলার অনুসারী ও উত্তেজিত জনতার সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ আহত হয়। আহতদের গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা তাদের ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে। পরবর্তীতে ফরিদপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন একজনের মৃত্যু হয়।
এসময় সেনাবাহিনী ও র্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।
কিন্তু বিকেল ৪টার দিকে পরিস্থিতি ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ওই স্থান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। এসময় উত্তেজিত জনতা বাড়ি-ঘরে হামলা করে ভাঙচুর চালায় ও লুটপাট করে। পরে তারা নুরাল পাগলার কবর ভেঙে তার মরদেহ ঢাকা-খুলনা মহাড়কে নিয়ে যায়। সড়কের পদ্মার মোড়ে নিয়ে তারা পেট্রোল ঢেলে মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আবারও সেনাবাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ঘটনা নিয়ে ওই এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এদিকে, রাজবাড়ী সদর, বালিয়াকান্দি, পাংশা, কালুখালী উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে তৌহিদী জনতা।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ আগস্ট নুরাল পাগলার মৃত্যুরে পর তার পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে নিজ বাড়ির সামনে দুইতলা সমান [প্রায় ১২ ফুট উঁচু] একটি কাঠামোর ভেতরে কবর দেওয়া হয়। পরে কবরটিকে কাবা শরীফের আদলে রং করা হয় এবং 'হযরত ইমাম মাহদী (আ.) দরবার শরীফ'- লেখা ব্যানার টাঙানো হয়।
স্থানীয় জনতার মধ্যে এতে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গোয়ালন্দ উপজেলার ইমাম পরিষদ ও তৌহিদী জনতা গত ২৬ আগস্ট বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একাধিকবার মতবিনিময় সভা হয়।
তৌহিদী জনতা ও ইমাম পরিষদের পক্ষ থেকে তিনটি দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হলো- কবর থেকে কাবা শরীফের আদলে করা রং পরিবর্তন; 'হযরত ইমাম মাহদী (আ.) দরবার শরীফ'- লেখা সাইনবোর্ড অপসারণ এবং কবরের উচ্চতা কমিয়ে স্বাভাবিক করা।
নুরাল পাগলার ভক্ত ও পরিবারবর্গ প্রথম দুটি দাবি মেনে নিলেও, কবরের উচ্চতা স্বাভাবিক করার বিষয়ে আলোচনার জন্য গত ২৮ আগস্ট পর্যন্ত সময় চায়। পরে তারা সময় বাড়িয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সময় নেয়।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার ইমান আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে জেলার ৫ উপজেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নাহিদুল রহমান বলেন, 'এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আমার গাড়ি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ও থানার ওসির গাড়ি ভাঙচুর করেছে জনতা। পরে নুরাল পাগলার আস্তানায় হামলা চালিয়েছে। তার মরদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দিয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যা এখনও বলতে পারব না। পরিস্থিতি এখন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।'
এদিকে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি বিবৃতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'অন্তর্বর্তী সরকার গোয়ালন্দে নুরুল হক মোল্লা, যিনি নুরাল পাগলা নামেও পরিচিত, তার কবর অবমাননা ও মরদেহে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায়। এই অমানবিক ও ঘৃণ্য কাজটি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আইন এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সভ্য সমাজের মৌলিক ভিত্তির ওপর সরাসরি আঘাত।'
বলা হয়, 'এই ধরনের বর্বরতা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না। অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং প্রতিটি মানুষের জীবনের পবিত্রতা, জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
এতে আরও বলা হয়, 'আমরা জনগণকে আশ্বস্ত করছি যে এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হবে এবং আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। যারা এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'
বিবৃতিতে বলা হয়, 'আমরা দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ঘৃণা ও সহিংসতাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করুন, সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন এবং ন্যায়বিচার ও মানবতার আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা গড়ে তুলুন।'
