ফুলেফেঁপে উঠছে কে-বিউটির বাজার: ত্বকের চিকিৎসায় কোরিয়ায় ভিড় করছেন বিদেশিরা, বদলে যাচ্ছে চিকিৎসা পর্যটন

দক্ষিণ কোরিয়ার ত্বকের চিকিৎসার ক্লিনিকগুলোতে এখন বিদেশি রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। কে-বিউটি বা দেশটির সৌন্দর্য ও প্রসাধনী শিল্পের বিশ্বজোড়া খ্যাতির কারণেই এমন পরিবর্তনের দেখা মিলছে। ত্বকের চিকিৎসা এখন মেডিকেল ট্যুরিজম বা চিকিৎসা পর্যটনের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
কোরিয়া হেলথ ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট – এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৭ লক্ষ ৫ হাজার বিদেশি নাগরিক দক্ষিণ কোরিয়াকে ত্বকের চিকিৎসার জন্য বেছে নিচ্ছেন। এই সংখ্যাটি ২০০৯ সালের তুলনায় ১১৭ গুণ বেশি। সেসময়ে মাত্র ৬,০০০ রোগী এই ধরনের সেবা নিতে আসতেন। ১৫ বছর আগে যেখানে মোট বিদেশি মেডিকেল পর্যটকদের মাত্র ৯.৩ শতাংশ ত্বকের চিকিৎসা নিতেন, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬.৬ শতাংশে।
এই বিপুল চাহিদার কারণে ২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় মোট বিদেশি রোগীর সংখ্যা রেকর্ড ১১.৭ লক্ষে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫০ লক্ষের বেশি বিদেশি নাগরিক দেশটিতে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন।
সরকার এই সাফল্যকে একটি বড় মাইলফলক হিসেবে দেখছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জং ইউন-ইয়ং বলেন, 'আমরা ২০২৭ সালের মধ্যে ৭ লক্ষ বিদেশি রোগী আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম, কিন্তু সময়ের আগেই তা অর্জন করতে পেরেছি।'
যেভাবে প্লাস্টিক সার্জারিকে পেছনে ফেলল ত্বকের চিকিৎসা
কিছুদিন আগেও দক্ষিণ কোরিয়ার মেডিকেল ট্যুরিজম মানেই ছিল প্লাস্টিক সার্জারি বা ইন্টারনাল মেডিসিন। ২০১৯ সালেও সবচেয়ে বেশি বিদেশি রোগী আসতেন এই দুটি খাতেই। কিন্তু ২০২৩ সালের মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে শীর্ষস্থান দখল করে নেয় ডার্মাটোলজি বা ত্বকের চিকিৎসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তনের মূল কারণ হলো 'কে-বিউটি'-র আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। এখন ক্লিনিকাল স্কিন ট্রিটমেন্ট বা ত্বকের চিকিৎসা দেশটির কসমেটিকস শিল্পেরই একটি অংশ হয়ে উঠেছে। অনেক ক্লিনিক এখন চিকিৎসার পাশাপাশি নিজেদের তৈরি স্কিনকেয়ার পণ্যও রোগীদের কাছে বিক্রি করছে, যা চিকিৎসা এবং সৌন্দর্য পণ্যের এক দারুণ মেলবন্ধন তৈরি করেছে।
কারা আসছেন বেশি?
মূলত জাপান, তাইওয়ান এবং চীনের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর তরুণ ভ্রমণকারীরাই সবচেয়ে বেশি আসছেন। তাদের কাছে সিউলের ক্লিনিকগুলো যেমন সহজলভ্য, তেমনই আধুনিক।
২০২৪ সালে বিদেশি ডার্মাটোলজি রোগীদের মধ্যে ৪৩.৭ শতাংশই ছিলেন জাপানের নাগরিক। এরপরই রয়েছে চীনের (২৪.৪%) এবং তাইওয়ানের (৯.৬%) নাগরিকরা।
অর্থনীতির পালে নতুন হাওয়া
মেডিকেল ট্যুরিজমের এই জোয়ারে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিও বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালে বিদেশি রোগী এবং তাদের সঙ্গীরা সব মিলিয়ে প্রায় ৭.৫ ট্রিলিয়ন ওয়ান (৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) খরচ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে ডার্মাটোলজি খাত থেকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আশা করছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বিদেশি রোগীর সংখ্যা ১৪ লক্ষে পৌঁছাতে পারে। সম্প্রতি মার্কিন তারকা কিম কারদাশিয়ান তার বোনকে নিয়ে সিউলের একটি ক্লিনিকে ত্বকের পরিচর্যা করাতে এলে এই খাতটি বিশ্বজুড়ে আরও বেশি আলোচনায় আসে।
সাফল্যের উল্টো পিঠ ও উদ্বেগ
তবে এই বিপুল সাফল্যের একটি উল্টো পিঠও রয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ সতর্ক করছেন যে, মেডিকেল ট্যুরিজমের এই দ্রুত সমৃদ্ধির দেশের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য তৈরি করতে পারে। যদি দেশের সেরা চিকিৎসক ও ব্যবসাগুলো শুধু লাভজনক কসমেটিক চিকিৎসার দিকেই ঝুঁকে পড়ে, তাহলে সাধারণ নাগরিকরা উন্নত সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। একে স্বাস্থ্যখাতে 'দুই স্তরবিশিষ্ট' ব্যবস্থা তৈরির ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অবশ্য, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে তারা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। তাদের মতে, দেশের নাগরিকদের জন্য চিকিৎসা সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে তারা সচেষ্ট।