যুক্তরাষ্ট্র দ. কোরিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন নির্মাণে সহায়তা করবে, এর গুরুত্ব কী
দক্ষিণ কোরিয়া জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন নির্মাণের একটি চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছেছে দেশটি। খবর বিবিসির।
হোয়াইট হাউস বৃহস্পতিবার প্রকাশিত একটি তথ্যপত্রে বলেছে, ওয়াশিংটন ইতোমধ্যে এসব "অ্যাটাক সাবমেরিন" নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে এবং জ্বালানি সংগ্রহে [দ. কোরিয়াকে] সহযোগিতায় সম্মত হয়েছে।
কোরীয় উপদ্বীপে যখন উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়ছে এবং পাশাপাশি চীনের সামুদ্রিক বিস্তৃতি গোটা অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে, তখন এই সমঝোতাটি সিউল–ওয়াশিংটন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চুক্তিতে কী আছে?
গত মাসের শুরুতে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার পরই এই সামরিক চুক্তি সামনে আসে, যেখানে দ. কোরিয়ার ওপর মার্কিন শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বছরের শুরুতে সিউলের পণ্যের ওপর এই ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন। পরে দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের (যার মধ্যে ২০০ বিলিয়ন নগদ বিনিয়োগ এবং ১৫০ বিলিয়ন ডলার জাহাজ নির্মাণখাতে) প্রতিশ্রুতি দিলে ট্রাম্প শুল্ক কমাতে সম্মত হন।
হোয়াইট হাউসের বৃহস্পতিবারের বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র "দক্ষিণ কোরিয়াকে পারমাণবিকচালিত অ্যাটাক সাবমেরিন নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছে… এবং প্রকল্পটির চাহিদা পূরণে, বিশেষ করে জ্বালানি সংগ্রহের বিষয়ে, ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করবে।"
এর আগে ট্রাম্প তাঁর সামাজিক মাধ্যম 'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ লিখেছিলেন, সাবমেরিনগুলো নির্মিত হবে ফিলাডেলফিয়ার একটি শিপইয়ার্ডে, যা দক্ষিণ কোরীয় কনগ্লোমারেট হানওয়ার অধীনে পরিচালিত।
বর্তমানে মাত্র ছয়টি দেশের কাছে কৌশলগত পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন রয়েছে। এসব দেশ হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ভারত।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ২০টি সাবমেরিন রয়েছে, তবে সবগুলোই ডিজেলচালিত, ফলে বাতাসের জন্য এগুলোকে প্রায়ই পানির উপরিস্তরে আসতে হয়। সে তুলনায়, পারমাণবিক সাবমেরিন অনেক বেশি দূর ও দ্রুত চলতে পারে, এবং একটানা দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকতে পারে।
ট্রাম্প লিখেছিলেন, "পুরোনো ধাঁচের, কম গতিশীল ডিজেলচালিত সাবমেরিনের বদলে, যা তারা এখন ব্যবহার করে—আমি তাদের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছি।"
পারমাণবিক শক্তির বেসামরিক খাতে দক্ষিণ কোরিয়া একটি শক্তিশালী শিল্পভিত্তি গড়ে তুলেছে। ১৯৭০-এর দশকে তারা পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালালেও যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে তা বন্ধ করে। ফলে দেশটির ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বা পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধের আওতায় রয়েছে, এবং সেটি পুরোপুরি আমদানি নির্ভর।
দক্ষিণ কোরিয়া কেন পারমাণবিক সাবমেরিন চায়?
এই নতুন সাবমেরিন প্রকল্পের লক্ষ্য মূলত উত্তর কোরিয়ার মোকাবিলা করা, যারা সম্প্রতি তাদের নিজস্ব পারমাণবিক সাবমেরিন কর্মসূচি চালু করার ঘোষণা দিয়েছে।
এপ্যাক সম্মেলনে গত মাসে দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ং ট্রাম্পকে সরাসরি জানিয়েছিলেন যে এই উদ্দেশ্যেই দক্ষিণ কোরিয়ার এসব সাবমেরিন প্রয়োজন।
গত সপ্তাহে টিভি সাক্ষাৎকারে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আহন গিউ-ব্যাক বলেন, পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষায় "একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন" এবং উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গঠনে বড় অগ্রগতি।
তিনি আরও বলেন, এই ধরনের সাবমেরিনের লুকিয়ে থাকার সক্ষমতা উ. কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের "রাতের ঘুম কেড়ে নেবে।"
উত্তর কোরিয়ার কি পারমাণবিক সাবমেরিন আছে?
দক্ষিণ কোরীয় কর্মকর্তাদের মতে, উত্তর কোরিয়াও রাশিয়ার সাহায্যে সম্ভাব্য একটি পারমাণবিক সাবমেরিন কর্মসূচি এগিয়ে নিচ্ছে।
২০২৫ সালের মার্চে উত্তর কোরিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন নির্মাণাধীন আছে বলে দাবি করে ছবি প্রকাশ করে, যেখানে কিম জং উনকে একটি শিপইয়ার্ড পরিদর্শন করতে দেখা যায়।
পিয়ংইয়ং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব সাবমেরিন হাতে পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া দেশটির কাছে থাকা মোট পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা আনুমানিক ৫০টির মতো।
দ. কোরিয়ার সেজং ইনস্টিটিউটের গবেষক জো বি-ইউন বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন সংগ্রহ করা পূর্ব এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার অংশ।
তিনি বিবিসিকে বলেন, "উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র এখন একটি প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। [দ. কোরিয়ার] পারমাণবিক সাবমেরিন অর্জন কেবল উত্তেজনা বাড়ার বৃহত্তর প্রবণতারই প্রতিফলন।"
এতে কি কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা বাড়বে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব সাবমেরিন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষায় কতটা কার্যকর হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সামরিক ভারসাম্য নাটকীয়ভাবে বদলে দেবে না।
আসান ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. ইয়াং উক বিবিসিকে বলেন, এই সাবমেরিনের মূল উদ্দেশ্য দ. কোরিয়ার নাগরিকদের আশ্বস্ত করা যে সরকার উ. কোরিয়ার হুমকি মোকাবিলায় তারা সক্রিয়।
তিনি বলেন, "দক্ষিণ কোরিয়া নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে না। তাহলে কী করতে পারে? পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন মোতায়েন।"
তবে ড. ইয়াং মনে করেন, উত্তর কোরিয়া এতে উল্টো সন্তুষ্ট হবে, কারণ এটি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ধরে রাখার যুক্তিকে আরও শক্তিশালী করবে—যা পিয়ংইয়ংকে নিরস্ত্রীকরণে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগকে আরও কঠিন করে তুলবে।
তবুও গবেষক জো মনে করেন, এই নতুন চুক্তি দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য একটি "বড় কৌশলগত পরিবর্তন", যা ইঙ্গিত দেয় এখন সিউল আঞ্চলিক নিরাপত্তা রাজনীতিতে একটি বড় খেলোয়াড়।
তিনি বলেন, "পারমাণবিক সাবমেরিনের বড় সুবিধা হলো এর গতি। এখন দক্ষিণ কোরিয়া দ্রুত, দূরে এবং যৌথভাবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অভিযান চালাতে পারবে।"
যুক্তরাষ্ট্র এখানে কী লাভ দেখছে?
ওয়াশিংটনের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রকল্পে সমর্থন মূলত উত্তর কোরিয়া ও চীনের ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে কাজ করবে।
ড. ইয়াং বলেন, "ট্রাম্প প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বোঝা দক্ষিণ কোরিয়ার কাঁধে তুলে দিয়েছেন। সিউল তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপকভাবে বাড়াবে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে চীন ও উত্তর কোরিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করবে।"
এশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটন ও বেইজিং দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তারের লড়াই চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন দক্ষিণ কোরিয়ার সামুদ্রিক সীমানার কাছে নৌ উপস্থিতি বাড়িয়েছে—যা দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের আচরণেরই ধারাবাহিকতা।
ড. ইয়াং মনে করেন, এই সমঝোতা বেইজিংকে "ক্ষুব্ধ" করবে।
চুক্তি ঘোষণার পর দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত দাই বিং বলেন, তিনি আশা করেন সিউল "সব পক্ষের উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়ে সতর্কভাবে বিষয়টি পরিচালনা করবে।"
তিনি আরও জানান, বেইজিং এ বিষয়ে সিউলের সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা করছে এবং তিনি অঞ্চলটির "জটিল ও সংবেদনশীল" নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথাও তুলে ধরেন।
কোথায় নির্মাণ হবে তা নিয়ে দ্বিমত?
ট্রাম্প বলেছেন সাবমেরিনগুলো ফিলাডেলফিয়ায় নির্মিত হবে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান বাড়বে। তবে দক্ষিণ কোরীয় কর্মকর্তারা বলছেন, সেগুলো অবশ্যই স্থানীয়ভাবে তৈরি করতে হবে, কারণ সিউলের বিদ্যমান জাহাজ নির্মাণশিল্পের অবকাঠামো অনেক দ্রুত সময়সীমায় এগুলো নির্মাণ করতে সক্ষম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কিম মিন–সক সংসদীয় শুনানিতে বলেছেন, ফিলাডেলফিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া–মালিকানাধীন জাহাজ কারখানাটির এমন সাবমেরিন নির্মাণের "সামর্থ্য নেই"।
এ বিষয়ে এখনো হানওয়ার পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি।
তবে চুক্তি হয়ে যাওয়ায় এখন পরবর্তী ধাপ হলো দুই দেশের পারমাণবিক চুক্তি সমন্বয় করা—যাতে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ করতে পারে এবং এর সামরিক ব্যবহারের সীমারেখা নির্ধারণ করা যায়।
