ডিজিটাল যুগে চিঠির ব্যবসায় লোকসান, বন্ধ হচ্ছে ডেনমার্কের চিঠি বিতরণ সেবা

ভোরের আলো ফোটার আগেই ব্যাগে চিঠি, ছোট পার্সেল আর ম্যাগাজিনের গুচ্ছ গুছিয়ে স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন হারম্যান ময়ানো।
গত সাত বছর ধরে তিনি ডেনমার্কের জাতীয় ডাকসেবা 'পোস্টনর্ড'-এর হয়ে বাড়িতে বাড়িতে চিঠি পৌঁছে দিচ্ছেন।
'আগে মনে হতো, প্রতিটি বাড়িতে কেউ না কেউ কোনও কিছুর অপেক্ষায় আছে—একটা বিশেষ চিঠি বা বার্তা কিংবা কোনও বিশেষ প্যাকেজ,' তিনি বলেন।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে হারম্যান লক্ষ্য করেছেন, ডাকের বোঝা আগের চেয়ে অনেক হালকা। বিশেষ চিঠির বদলে এখন ডাকপিয়নের ব্যাগ ভরে থাকে মূলত বিদ্যুৎ বিল আর ব্যাংকের হিসাবপত্রে।
'গত দুই বছরে এই কমে যাওয়ার গতি আরও বেড়েছে। এখন বোধ হয়, চিঠিপত্রের প্রচলন অনেকটাই কমে এসেছে,' হারম্যান বলেন।

গত মার্চে পোস্টনর্ড ঘোষণা করেছে, বছরের শেষে তারা চিঠি বিতরণ পরিষেবা বন্ধ করে দেবে। এর মধ্য দিয়ে চার শতকেরও বেশি সময় ধরে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত ডাকসেবার চিঠি বিতরণের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটবে।
চিঠি খাতে এই লোকসানের কারণে সংস্থাটির প্রায় ২ হাজার ২০০ কর্মী ছাঁটাই করা হবে, যা মোট কর্মীর এক-তৃতীয়াংশ। তবে তুলনামূলকভাবে লাভজনক পার্সেল খাতে জোর দেবে পোস্টনর্ড, যেখানে ৭০০ নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে।
পোস্টনর্ডের প্রধান কিম পেডারসেন বলেন, 'ডেনিশরা এখন প্রায় কোনও চিঠিই পান না, পাঠানও না। বহু বছর ধরেই এটি চলে আসছে। গড়ে মাসে একজন মাত্র একটি চিঠি পান, যা খুবই কম।'
'বরং ডেনিশরা অনলাইনে কেনাকাটা করতে ভালোবাসে। বৈশ্বিক ই-কমার্স দ্রুত বাড়ছে, আর আমরাও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছি,' বলেন তিনি।
পনেরো বছর আগে পোস্টনর্ডের বিশাল কয়েকটি লেটার-সোর্টিং সেন্টার ছিল। আর এখন বাকি আছে শুধু একটি।
২০০০ সাল থেকে পোস্টনর্ডের হাতে আসা চিঠির পরিমাণ ৯০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। তখন বছরে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন চিঠি আসত, কিন্তু গত বছর তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১ কোটি।
চিঠি বিতরণ বন্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ডেনমার্কের রাস্তাঘাট থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে ১ হাজার ৫০০টি লাল ডাকবাক্স। রাজধানীতে এগুলো ব্যবহার করতে খুব একটা দেখা যায় না।
কোপেনহেগেনের বাসিন্দা নিকোলাজ ব্র্যোনার আন্দ্রেস বলেন, 'শেষ কবে আমি চিঠি পাঠিয়েছি তা মনে করতে পারছি না… আসলে এখন ঠিক মনেও নেই কীভাবে চিঠি পাঠাতে হয়।'
ডেনমার্ক বিশ্বের অন্যতম ডিজিটালাইজড দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটিতে প্রায় সবকিছুর জন্য একটি অ্যাপ রয়েছে, খুব কম মানুষই নগদ টাকা ব্যবহার করে; এমনকি ডেনিশরা তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং স্বাস্থ্য কার্ড স্মার্টফোনে বহন করেন।
ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বিল, এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে চিঠিপত্র সবই ডিজিটালি পাঠানো হয়।
সরকারি সেবাগুলো ডিজিটাল পোস্ট অ্যাপ বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে। পোস্টনর্ড ডেনমার্ক তাই জানিয়েছে, চিঠির বাজার আর লাভজনক নয়।
শতাব্দীর শুরু থেকে ডেনমার্কে চিঠির পরিমাণ ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন থেকে ২০২৩ সালে ১১০ মিলিয়নে নেমে এসেছে।
এই সিদ্ধান্তটি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে বয়স্কদের। ৯৫ শতাংশ ডেনিশ নাগরিক ডিজিটাল পোস্ট সেবা ব্যবহার করেন। তবে প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২ লাখ ৭১ হাজার মানুষ এখনও সরাসরি চিঠির ওপর নির্ভরশীল।
পোস্টনর্ড বছরের পর বছর আর্থিক সংকট মোকাবিলা করেছে এবং গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ঘাটতিতে ছিল।

চিঠি পাঠানোর অতিরিক্ত ব্যয়ও চিঠির পরিমাণ কমে আসার একটি কারণ।
২০২৪ সালে নতুন একটি আইনের মাধ্যমে ডাকসেবা খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর জন্য উন্মুক্ত করার জন্য অনুমোদন করা হয়। একই সঙ্গে ডাককে ভ্যাটমুক্ত সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে পোস্টনর্ডের একটি টিকিটের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ ড্যানিশ ক্রোন (প্রায় ৪.৫৫ ডলার বা ৩.৩৫ পাউন্ড)।
ডাক খাতে বিশেষজ্ঞ ও 'পার্সেল অ্যান্ড পোস্টাল টেকনোলজি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিনে' র সম্পাদক হ্যাজেল কিং বলেন, 'বহু বছর ধরে ইউরোপজুড়ে চিঠির পরিমাণ কমছে। পোস্টনর্ডের সিদ্ধান্ত মূলত পুরো বাজারের গতিপ্রকৃতির প্রতিফলন, আর ভোক্তাদের ব্যবহারের ধারা এটাতেই স্পষ্ট।'
চিঠির চাহিদা কমতে থাকায় ইউরোপের অন্যান্য দেশের ডাকসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোও পদক্ষেপ নিচ্ছে। ২০২৪ সালের মার্চে জার্মানির ডয়চে পোস্ট ৮ হাজার কর্মী ছাঁটাই করার ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাজ্যের ৫০০ বছরের পুরোনো রয়্যাল মেইলও খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির চিঠি সপ্তাহে একদিন কম বিতরণ করা হবে, আর প্রথম শ্রেণির ডাক পৌঁছানোর সময়সীমার লক্ষ্যও কমিয়ে আনা হয়েছে।
তবে ডেনমার্কে পুরোপুরি শেষ হচ্ছে না চিঠি বিতরণ। পোস্টনর্ডের শূন্যস্থান পূরণে দায়িত্ব নেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিএও, যারা সারা দেশে নিজেদের সেবা চালু করবে।