দনবাস ছেড়ে দেওয়া মানে আত্মসমর্পণ: ইউক্রেনের জন্য ট্রাম্প-পুতিন সমঝোতার সম্ভাব্য পরিণাম
আলাস্কায় ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তি প্রতিষ্ঠার শর্ত হিসেবে যাকে "ল্যান্ড সোয়াপস" বা ভূখণ্ডের অদলবদল বলেছেন, সেটি ইউক্রেনীয়দের জন্য ছিল এক বিভ্রান্তিকর শব্দবন্ধ। খবর বিবিসির।
কোন জমি বদল হবে? রাশিয়া যে ভূমি দখল করেছে, তার বিনিময়ে কি ইউক্রেনকে রাশিয়ার কোনো অংশ দেওয়া হবে?—প্রশ্ন ছিল সবার।
আজ সোমবার ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করতে ওয়াশিংটনে গেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিন্তায় কোনো বাস্তব "অদলবদল" নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।
বরং ট্রাম্প নাকি চাইছেন, জেলেনস্কি যেন পুরো পূর্বাঞ্চলীয় দোনেস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেন—বদলে রাশিয়া বাকি ফ্রন্টলাইনে অগ্রযাত্রা স্থগিত রাখবে। এই প্রস্তাব আলাস্কা বৈঠকে দিয়েছিলেন পুতিন।
লুহানস্ক প্রদেশ প্রায় পুরোপুরি রুশ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তবে ইউক্রেন এখনো দোনেস্কের প্রায় ৩০ শতাংশ ভূখণ্ড ধরে রেখেছে—এর মধ্যে রয়েছে কৌশলগত কয়েকটি শহর ও শক্তঘাঁটি, যার জন্য ইউক্রেনকে দিতে হয়েছে হাজার হাজার প্রাণের মূল্য।
খনিজ ও শিল্পসমৃদ্ধ এ দুই অঞ্চল—যৌথভাবে পরিচিত "দনবাস" নামে। এখন এসব এলাকা রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হবে এক "বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডি", বলেন ইউক্রেনীয় ইতিহাসবিদ ইয়ারোস্লাভ হ্রিতসাক।
তিনি বলেন, "এটা ইউক্রেনের জমি ভূখণ্ড। এই অঞ্চলের মানুষ—বিশেষত খনি শ্রমিকরা—ইউক্রেনীয় জাতীয় চেতনা দৃঢ় করতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।"
তার মতে, এখানকার মাটিতে জন্ম নিয়েছে "খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, কবি ও ভিন্নমতাবলম্বী"। আর এখন তারা শরণার্থী, যারা রাশিয়ার দখলে চলে গেলে আর বাড়ি ফিরতে পারবে না।
২০১৪ সালে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ১৫ লাখ ইউক্রেনীয় দনবাস ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ রুশ দখলকৃত এলাকায় বসবাস করছে। আরও প্রায় তিন লাখ মানুষ এখনো ইউক্রেনীয় নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশে অবস্থান করছে।
ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি জীবনের ঝুঁকি ভয়াবহ। স্লোভিয়ানস্ক শহরের ৫৫ বছর বয়সী সামরিক বাহিনীর যাজক আন্দ্রি বরিলো ফোনে জানান, এই সপ্তাহান্তে তাঁর বাড়ির পাশেও গোলা এসে পড়েছে।
"খুব ভয়াবহ অবস্থা এখানে," তিনি বলেন। "হতাশা আর পরিত্যক্ত হওয়ার অনুভূতি ছড়িয়ে আছে। জানি না আমরা কতটা টিকে থাকতে পারব। কাউকে না কাউকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। কিন্তু কে করবে?"
আলাস্কা বৈঠকের খবর তিনিও দেখেছেন। "আমি দায়ী করি ট্রাম্পকে, জেলেনস্কিকে নয়। কিন্তু আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা বিশ্বাসঘাতকতা," বলেন বরিলো।
তবে জেলেনস্কি বারবার বলেছেন, তিনি শান্তিচুক্তির বিনিময়ে দনবাস ছেড়ে দেবেন না। আর রাশিয়া কোনো চুক্তি মানবে—এমন আস্থা ইউক্রেনীয়দের মধ্যে নেই। অনেকের আশঙ্কা, মস্কো ভবিষ্যৎ আগ্রাসনের জন্য এসব ভূখণ্ডই ব্যবহার করবে।
কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির জরিপ বলছে, প্রায় ৭৫ শতাংশ ইউক্রেনীয় কোনো ভূখণ্ড রাশিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে দেওয়ার বিপক্ষে।
তবু যুদ্ধ ক্লান্ত করেছে দেশটিকে। রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনের পর থেকে লাখ লাখ সেনা ও বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছেন। বিশেষ করে দনবাসের বাসিন্দারা শান্তির জন্য ব্যাকুল।
দোনেস্কের ক্রামাতোরস্ক শহরের জরুরি উদ্ধারকর্মী ৫৬ বছর বয়সী ইয়েভহেন তকাচভ বলেন, "আপনি জিজ্ঞেস করছেন দোনেস্ক ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে? আমি এই যুদ্ধকে কিলোমিটারে নয়, মানুষের প্রাণে মাপি। কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটারের জন্য আমি হাজার হাজার প্রাণ দিতে রাজি নই। জীবন ভূমির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।"
এই দ্বিধা–দ্বন্দ্বের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছেন জেলেনস্কি। ইউরোপিয়ান সলিডারিটি দলের বিরোধীদলীয় সাংসদ ভলোদমির আরিয়েভ বলেন, "আমাদের সীমাহীন সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি নেই। কিন্তু যদি জেলেনস্কি এই ভূখণ্ড ছেড়ে দেন, সেটা শুধু সংবিধান লঙ্ঘন নয়, রাষ্ট্রদ্রোহের মতো হবে।"
এমনকি আইনি দিক থেকেও পরিস্থিতি জটিল। ইউক্রেনের সংবিধান অনুযায়ী, দেশের কোনো ভূখণ্ড হস্তান্তরের জন্য সংসদ ও গণভোটের অনুমোদন প্রয়োজন।
সবচেয়ে সম্ভাব্য পথ হলো, কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়াই বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া। তবে সেটিরও কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই, বলছেন ইউক্রেনীয় সাংসদ ইন্না সোভসুন।
"এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই," তিনি বলেন। "প্রেসিডেন্ট কি কেবল একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন? নাকি সরকার করবে? সংসদ? কিছুই নির্ধারিত নয়, কারণ সংবিধান প্রণেতারা এমন পরিস্থিতি কল্পনা করেননি।"
আজ সোমবার ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির বৈঠকের পর হয়তো এসব কিছুটা পরিষ্কার হবে—এটাই হবে ফেব্রুয়ারির ওভাল অফিসে ব্যর্থ সাক্ষাতের পর জেলেনস্কির হোয়াইট হাউস সফর।
আলাস্কা বৈঠকের পর হতাশার আবহের মাঝেই ইউক্রেনের জন্য একটুখানি আশার আলো দেখা গেছে। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি ইউরোপের সঙ্গে মিলে ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে সামরিক সুরক্ষা দিতে প্রস্তুত।
ইউক্রেনীয়দের কাছে এই নিরাপত্তা নিশ্চয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যে কোনো ভূখণ্ড–সম্পর্কিত সমঝোতার চেয়েও বেশি, বলছেন কিয়েভ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আনতোন হ্রুশচেৎসকি।
তকাচভও একই কথা বললেন। "শুধু লিখিত প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব নিরাপত্তা গ্যারান্টি পেলে তবেই দনবাস ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। যদি ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি ওদেসার বন্দরে অবস্থান নেয়—তাহলে আমি রাজি।"
কিন্তু ট্রাম্পের ধাঁচের চুক্তির আলোচনায় আসল মানুষগুলো যেন হারিয়ে যাচ্ছে—সেইসব মানুষ, যারা দশ বছর ধরে যুদ্ধের মধ্যে বেঁচে আছেন, এবং এখন শান্তির নামে আরও বড় ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারেন।
"দনবাস ছিল নানা শ্রেণি-পেশার ইউক্রেনীয়দের জায়গা," বললেন ইতিহাসবিদ ভিতালি দ্রিবনিতসিয়া। "আমরা কেবল সংস্কৃতি, রাজনীতি বা জনসংখ্যা নিয়ে কথা বলছি না—আমরা কথা বলছি মানুষ নিয়ে।"
তিনি যোগ করেন, দোনেস্ক হয়তো ওদেসার মতো সাংস্কৃতিক খ্যাতি পায়নি। "কিন্তু সেটি ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রতিটি কোণ, সাংস্কৃতিক গুরুত্ব থাকুক বা না থাকুক, ইউক্রেনই।"
