মুম্বাইয়ে পাবলিক স্পেসে কবুতরকে খেতে দিলেই শাস্তি; ভারতজুড়ে তীব্র বিতর্ক

ভারতের মুম্বাইয়ে জনসমাগমস্থলে কবুতর খাওয়ানো নিষিদ্ধের সাম্প্রতিক আদালতের রায়কে ঘিরে তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে দেশটিতে। বিষয়টি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে পড়েছেন নগর কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্যকর্মী ও পাখিপ্রেমীরা।
কবুতর বহুদিন ধরেই ভারতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলের অংশ। বিশেষ করে জৈন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা কবুতরদের খাওয়াকে পুণ্যের কাজ বলে মনে করেন। বলিউডের সিনেমাগুলোতেও প্রায়ই কবুতরকে খাওয়ানোর দৃশ্য ব্যবহার করে মুম্বাই ও দিল্লির শহুরে জীবনকে তুলে ধরে হয়। শান্তি ও বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবেও দেখা হয় এ পাখিটিকে।
তবে এ মাসের শুরুতে কয়েক দশক পুরোনো একটি 'কবুতরখানা' বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদে দুই দফায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান শত শত মানুষ। কেউ কেউ অনির্দিষ্টকালের অনশন শুরু করারও হুমকি দেন। আরেকটি বিক্ষোভ থেকে পুলিশ প্রায় ১৫ জনকে আটক করেছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম।
কর্তৃপক্ষ জানায়, কবুতরের বিষ্ঠা থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কায় এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

সমস্যাটি শুধু মুম্বাইয়ের নয়। ইতালির ভেনিসে ঐতিহাসিক চত্বরে কবুতর খাওয়ানো নিষিদ্ধ। সিঙ্গাপুরে রয়েছে বড় অঙ্কের জরিমানা। নিউইয়র্ক ও লন্ডনে কবুতর খাওয়ানোর জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনে ও থানে শহরেও কবুতর খাওয়ানোর জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। রাজধানী দিল্লিও জনসমাগমস্থলে কবুতর খাওয়ানো ঠেকাতে নির্দেশনা জারি করার কথা ভাবছে।
এ ধরনের অভিযানে ক্ষুব্ধ প্রাণীপ্রেমী ও ধর্মীয় কারণে কবুতর খাওয়ানো মানুষজন।
তবে দীর্ঘ সময় কবুতরের বিষ্ঠার সংস্পর্শে থাকলে ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ে বলে একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে কবুতরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকিও আরও তীব্র হয়েছে। এ কারণেই বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে।

দিল্লিভিত্তিক জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞ ফাইয়াজ খুদসর জানান, সহজে খাবার পাওয়া যাওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশেই কবুতরের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ভারতে পরিস্থিতি আরও জটিল, কারণ গোরাইয়া বা ঘরচড়ুইয়ের মতো পাখি কমে যাওয়ায় তাদের জায়গা দখল করছে কবুতর।
২০২৩ সালের স্টেট অব ইন্ডিয়াজ বার্ডস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সালের পর থেকে ভারতে কবুতরের সংখ্যা বেড়েছে ১৫০ শতাংশেরও বেশি।
প্রতিটি কবুতর বছরে প্রায় ১৫ কেজি পর্যন্ত বিষ্ঠা ত্যাগ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব বিষ্ঠায় কমপক্ষে সাত ধরনের জীবাণু থাকে, যা নিউমোনিয়া, ফাঙ্গাল সংক্রমণ এমনকি মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
দিল্লির ৭৫ বছর বয়সী নির্মল কোহলি কয়েক বছর আগে থেকেই দীর্ঘস্থায়ী কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তার ছেলে জানান, 'অবশেষে সিটি স্ক্যানে দেখা যায়, মায়ের ফুসফুসের একটি অংশ সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা বলেন, এর কারণ হলো কবুতরের বিষ্ঠার সংস্পর্শে আসা।'
গত বছর দিল্লিতে ১১ বছরের এক ছেলে হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। চিকিৎসকেরা জানান, কবুতরের বিষ্ঠা ও পালকের দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শই এর মূল কারণ।
পালমোনোলজিস্ট আরএস পালবলেন, এ ধরনের ঘটনা খুবই সাধারণ।
তার ভাষায়, 'আপনি সরাসরি কবুতরকে খাবার না দিলেও জানালার কার্নিশ বা বারান্দায় জমে থাকা তাদের বিষ্ঠা থেকেই হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস হতে পারে। আমরা নিয়মিত কবুতর সামলানো মানুষদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাল ও ফাঙ্গাল সংক্রমণের ঘটনাও দেখি।'
এ ধরনের উদ্বেগের কারণেই গত মাসে মুম্বাই পৌর কর্তৃপক্ষ কবুতর খাওয়ানো নিষিদ্ধ করে এবং কবুতরখানা ভাঙার অভিযান শুরু করে।
অবশ্য বর্তমানে ভাঙার কাজ স্থগিত থাকলেও বোম্বে হাই কোর্ট কবুতর খাওয়ানো নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে করা একটি আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। আদালত রায়ে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে 'সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ' উল্লেখ করে অবৈধভাবে কবুতর খাওয়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

তবে প্রাণীপ্রেমীদের অনেকে এ অবস্থানের সঙ্গে একমত নন।
দিল্লির মোহাম্মদ ইউনুস, যিনি একটি কবুতরখানায় শস্য সরবরাহ করেন, বলেন, 'যথাযথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে সব প্রাণীর মাধ্যমেই রোগ ছড়াতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'গত ১৫ বছর ধরে আমি কবুতরের মাঝেই আছি। যদি কিছু হওয়ার থাকত, তবে আমারও এতদিনে হয়ে যেতো।'
প্রাণী অধিকার কর্মী মেঘা উনিয়াল বলেন, 'কর্তৃপক্ষ বারবার নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, কিন্তু এর মানে কী—আসলে কেউই তা জানে না।' কবুতর খাওয়ানো নিষিদ্ধের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্টতা নেই।
এদিকে পিপল ফর দ্য এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অব অ্যানিম্যালস (পেটা) ইন্ডিয়ার উজ্জ্বল আগ্রৈন প্রস্তাব দেন, সকাল ও সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে কবুতর খাওয়ানোর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, 'তাতে পৌর কর্তৃপক্ষের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করার যথেষ্ট সময় মিলবে। একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ও আবেগ—দুটিকেই সম্মান জানানো সম্ভব হবে।'
বোম্বে হাই কোর্ট ইতিমধ্যে বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে। মুম্বাই নগর কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত ও ধাপে ধাপে কবুতর খাওয়ানোর অনুমতি দেওয়া হতে পারে।