সাধারণ সর্দি-কাশিই কি ফিরিয়ে আনতে পারে ক্যান্সার?

সেরে ওঠার অনেকদিন পরেও ক্যান্সারের 'ঘুমন্ত' কোষগুলো শরীরে নীরবে লুকিয়ে থাকতে পারে। ফুসফুস, লিভার বা মস্তিষ্কের মতো অঙ্গে স্টেম সেলের পাশে এরা ঘাপটি মেরে বসে থাকে। বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ভেবে এসেছেন, ঠিক কোন জিনিসটি এই কোষগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারে?
সম্প্রতি বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল 'নেচার'-এ প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণা বলছে, ফ্লু এবং কোভিড-১৯ এর মতো সাধারণ সর্দি-কাশির অসুখই এই কাজটি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটির গবেষক জেমস ডিগ্রেগরি বলেন, "এরা (ক্যান্সার কোষ) বছরের পর বছর, এমনকি দশক ধরেও শরীরে বসে থাকতে পারে এবং আমরা সত্যি বলতে পুরোপুরি জানতাম না কী কারণে এরা জেগে ওঠে।" তিনি আরও বলেন, "তাই আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, ফুসফুসের কোনো সংক্রমণ কি এই ধরনের কোষকে জাগিয়ে তুলতে পারে? এবং আমরা দেখেছি, নাটকীয়ভাবেই সেটা সম্ভব।"
এই গবেষণার ফলাফল ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফেরা মানুষের জন্য বড় ধরনের প্রশ্ন তৈরি করেছে। তাহলে কি সাধারণ সর্দি বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে? আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভূমিকাটাই বা কী?
যেভাবে কোভিড এবং ফ্লু ক্যান্সারকে ফিরিয়ে আনতে পারে
ডিগ্রেগরি এবং তার চিকিৎসক ও গবেষকদের শক্তিশালী দলটি গবেষণায় দেখে, ফ্লু এবং কোভিড-১৯ ফুসফুসে ঘুমিয়ে থাকা ক্যান্সার কোষকে জাগিয়ে তুলতে পারে, অন্তত ইঁদুরের শরীরে এটাই দেখা গেছে। এর পাশাপাশি, কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন কয়েক হাজার ক্যান্সার রোগীর উপর চালানো একটি সমীক্ষাতেও ইঙ্গিত মিলেছে যে, মানুষের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।
আগের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বা সিগারেটের ধোঁয়ার কারণে সৃষ্ট প্রদাহ ফুসফুসের ঘুমন্ত ক্যান্সার কোষকে পুনরায় সক্রিয় করতে পারে। তাই গবেষক দলটি দেখতে চেয়েছিল, শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতা একই প্রভাব ফেলে কিনা।
এটি পরীক্ষা করার জন্য, গবেষকরা এমন কিছু ইঁদুরকে ফ্লু এবং করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত করেন, যাদের জেনেটিক্যালি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত করা হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায়, ইঁদুরগুলোর ফুসফুসের ঘুমন্ত ক্যান্সার কোষগুলো জেগে উঠতে শুরু করে।
প্রায় দেড় সপ্তাহ ধরে কোষগুলো সক্রিয় ছিল, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংক্রমণ চলে যাওয়ার সাথে সাথে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ডিগ্রেগরি বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস সংক্রমণ এই কোষগুলোকে কয়েক সপ্তাহের জন্য বাড়িয়ে তোলে, কিন্তু তারপর তারা আবার ঘুমাতে চলে যায়। কিন্তু এর মধ্যেই এরা প্রায় ১০০ গুণ পর্যন্ত সংখ্যায় বেড়ে যায়।"
অর্থাৎ, যদিও অনেক ইঁদুর সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়নি, কিন্তু সংক্রমণের সময় তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। কারণ ঘুমন্ত ক্যান্সার কোষগুলো এই সময়টাকে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করার জন্য ব্যবহার করেছিল।
এই জাগিয়ে তোলার পেছনের মূল কালপ্রিট হলো 'ইন্টারলিউকিন-৬' বা আইএল-৬ (IL-6) নামক এক ধরনের প্রোটিন। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই সমন্বয় করতে এই প্রোটিন ব্যবহার করে। ডিগ্রেগরি ব্যাখ্যা করেন, "এটি মূলত একটি প্রোটিন যা কোষের মধ্যে যাতায়াত করে। শরীরে কোনো সংক্রমণ দূর করার জন্য এটি একটি স্বাস্থ্যকর জিনিস হতে পারে।"
কিন্তু যখন আইএল-৬ ঘুমন্ত ক্যান্সার কোষের সংস্পর্শে আসে, তখনই সমস্যা তৈরি হয়। ডিগ্রেগরি বলেন, "যখন ঘুমন্ত কোষগুলো উপস্থিত থাকে, তখন তারা এই প্রদাহজনক পরিবেশের সুযোগ নেয়। এটি তাদের সংখ্যা বাড়াতে, জেগে উঠতে এবং এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে সাহায্য করে, যেখানে আপনার শরীরে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের বোঝা অনেক বেড়ে যায়। অর্থাৎ, ক্যান্সার কোষগুলো এমন একটি ব্যবস্থাকে ছিনতাই করে, যা সাধারণত ভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে ব্যবহৃত হতো।"
মানুষের ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনা ঘটতে পারে?
বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন যে ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফেরা মানুষেরা যখন শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হন, তখন তাদের শরীরেও একই ঘটনা ঘটে কিনা। তবে প্রাথমিক প্রমাণ বলছে, এটা সম্ভব। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের দুটি ডেটাবেস বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরে ফুসফুসে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়া এবং এর কারণে মৃত্যুর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের বায়োব্যাংকের তথ্য দেখায়, মহামারী শুরু হওয়ার অন্তত পাঁচ বছর আগে যাদের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল, তাদের মধ্যে যারা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ক্যান্সার-সম্পর্কিত মৃত্যুর হার প্রায় দ্বিগুণ। বিশেষ করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের আরেকটি দলে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস পজিটিভদের সাথে তাদের ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
এই গবেষণার সাথে জড়িত নিউ ইয়র্কের ক্যান্সার ডরম্যান্সি ইনস্টিটিউটের পরিচালক জুলিও এ. আগুয়েরে-ঘিসো বলেন, ঘুমন্ত কোষগুলো প্রায়শই চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যায় কারণ তারা সাধারণ টিউমার কোষের মতো আচরণ করে না। একারণেই, ক্যান্সার থেকে সেরে ওঠা রোগীদের শরীরেও ঘুমন্ত ক্যান্সার কোষ টিকে থাকতে পারে। তিনি বলেন, "আমাদের কাছে যে থেরাপিগুলো আছে, সেগুলো বিভাজিত কোষকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু এই ঘুমন্ত ক্যান্সার কোষগুলো বিভাজিত হয় না।"
তা সত্ত্বেও, আগুয়েরে-ঘিসো বলেন, অনেক রোগী শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরেও বাকি জীবন ঘুমন্ত ক্যান্সার কোষ নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারেন, যা আর কখনও জেগে ওঠে না। তিনি আরও বলেন, "কিছু রোগী হয়তো এমন একটি পর্যায়ে থাকেন যেখানে তাদের ক্যান্সার পুনরায় সক্রিয় হওয়ার পথে, অথবা তাদের রোগটি বেশ অগ্রসর। তখন এই প্রদাহ কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক রোগের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু এমন অনেক রোগীও থাকতে পারেন যারা বহুবার সংক্রমণে আক্রান্ত হন, কিন্তু তাদের মধ্যে পুনরায় ক্যান্সার সক্রিয় হওয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি চালু হয় না"
তবে ইঁদুরের শরীরে যা ঘটেছে, তা যদি মানুষের ক্ষেত্রেও সত্যি হয়, তবে ফ্লু বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়াটা ক্যান্সার থেকে সেরে ওঠা রোগীদের জন্য একটি বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে। প্রদাহ ঘুমন্ত কোষগুলোকে সংখ্যাবৃদ্ধি করার সুযোগ করে দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে, এমনকি যদি তারা কয়েক সপ্তাহ পরে আবার ঘুমিয়েও পড়ে।
চিকিৎসকরা যদিও নিশ্চিতভাবে জানেন না কতজন ক্যান্সার রোগীর শরীরে ঘুমন্ত কোষ তৈরি হয়, তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ এবং ফুসফুস-সম্পর্কিত ক্যান্সার মৃত্যুর মধ্যেকার সম্পর্ক বিবেচনা করে, শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতা এড়াতে সতর্কতা অবলম্বন করা ক্যান্সার রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে। এর মাধ্যমে ঘুমন্ত কোষগুলোকে জেগে ওঠা থেকে আটকানো সম্ভব হতে পারে।
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নন এমন একজন চিকিৎসক, টেক্সাসের এমডি অ্যান্ডারসন ক্যান্সার সেন্টারের পালমোনোলজিস্ট এডউইন অস্ট্রিন বলেন, "এটা খুবই সাধারণ জ্ঞানের বিষয় যে, বিশেষ করে যারা ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব থাকতে পারে, তাদের উচিত সব ধরনের টিকার ব্যাপারে হালনাগাদ থাকা।"