৬ মাস ধরে দেশে রেডিওআয়োডিনের সংকট, বিপাকে থাইরয়েড ক্যান্সারের রোগীরা

মুন্সিগঞ্জের লোহাগড়ার সুপারশপকর্মী আমিনুর রহমান (৪৫) সাড়ে তিন মাস আগে থাইরয়েড ক্যান্সারের অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সার্জারির ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে তার রেডিওআয়োডিন থেরাপি নেওয়ার কথা ছিল।
তবে গত সাড়ে তিন মাস ধরে মাসে দুই-তিনবার রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালাইড সায়েন্সেস (এনআইএনএমএএস)-এ যোগাযোগ করেও তিনি থেরাপি পাওয়ার কোনো আশ্বাস পাননি। এতে ক্যান্সার ফিরে আসার আতঙ্কে রয়েছেন তিনি।
আমিনুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "ল্যাবএইড হাসপাতালে সার্জারিতে দুই লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এখন যদি ক্যান্সার ফিরে আসে তাহলে কী হবে সেই ভয়ে থাকি। শুধু আমি নই, প্রতিদিন আরও অনেক রোগী রেডিওআয়োডিনের খোঁজে ফিরে যাচ্ছেন। কবে ওষুধ আসবে কেউ বলতে পারে না।"
একই সংকটে রয়েছেন দুবাইপ্রবাসী আহমেদ আলি। সিলেটের হবিগঞ্জের বাসিন্দা আহমেদ দেড় মাস আগে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে থাইরয়েড ক্যান্সারের সার্জারি করান। এরপর থেকে সিলেটের ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালাইড সায়েন্সেস এবং ঢাকার বিএমইউ-তে নিয়মিত যোগাযোগ করেও তিনি থেরাপি পাওয়ার কোনো তারিখ জানতে পারেননি।
আহমেদ আলি বলেন, "সার্জারির পর ডাক্তার আয়োডিন থেরাপি নিতে বলেন। তারপর থেকে সিলেট পরমাণু শক্তি কমিশন ও পিজিতে নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছি। সবাই বলছে দেড়-দুই মাস পর জানাবে ওষুধ দেশে এসেছে কিনা। আমার ভেতরে আতঙ্ক কাজ করছে—যদি ওষুধ না পেয়ে ক্যান্সার আবার ফিরে আসে।"
আমিনুর রহমান ও আহমেদ আলির মতো সার্জারির পর রেডিওআয়োডিন থেরাপির অপেক্ষায় থাকা অন্তত ২,৫০০ থাইরয়েড ক্যান্সার রোগী ক্যান্সার ফিরে আসার আশঙ্কায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন বিদেশ থেকে এ ওষুধ আমদানি করে দেশের ২৪টি পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রে সরবরাহ করে থাকে।
জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের থাইরয়েড সার্জন ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আবদুল করিম বলেন, "ক্যান্সার চিকিৎসা একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। অপারেশন ভালো হলেও রেডিওআয়োডিন থেরাপি না পেলে সম্পূর্ণ চিকিৎসা সম্ভব হয় না। এই ঘাটতি রোগীদের জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "থাইরয়েড ক্যান্সারের সার্জারির পর রেডিওআয়োডিন থেরাপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি না দিলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, ফলে রোগটি পুনরায় ফিরে আসতে পারে।"
"আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, রেডিওআয়োডিন থেরাপি না দিলে ৩০-৪০ শতাংশ রোগীর মধ্যে ক্যান্সার ফেরার ঝুঁকি থাকে। নিয়ম অনুযায়ী অপারেশনের ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে থেরাপি দিতে হয়। কিন্তু দেশে এ সংকট চলছে প্রায় ৬ মাস ধরে। রোগীদের অন্য কেন্দ্রে পাঠালেও তারা ফিরে এসে জানাচ্ছেন, ওষুধ পাচ্ছেন না," যোগ করেন তিনি।
চিকিৎসকেরা জানান, থাইরয়েড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয় না; রেডিওআয়োডিন সেবনই যথেষ্ট। তবে দেরি হলে ক্যান্সার থাইরয়েড গ্ল্যান্ড থেকে শরীরের অন্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু হানিফ বলেন, "প্রায় ৬ মাস ধরে রেডিওআয়োডিন সংকট চলছে বলে রোগীরা জানাচ্ছেন। এই আইসোটোপ আমদানি করে পরমাণু শক্তি কমিশন, কিন্তু সমস্যায় পড়ছে রোগী, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যখাত। আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিশেষ সহকারীর সঙ্গে কথা বলেছি, পরমাণু শক্তি কমিশনকেও জানিয়েছি—বিষয়টি দ্রুত সমাধান হওয়া জরুরি।"
ফেসবুকভিত্তিক রোগী সহায়তা কমিউনিটি 'থাইরয়েড সাপোর্ট গ্রুপ'-এর অ্যাডমিন ফারজানা হাফিজ জানান, "প্রতিদিন বহু রোগী উদ্বেগ জানিয়ে পোস্ট করছেন, বিকল্প চিকিৎসার উপায় জানতে চাইছেন, কেউ কেউ বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সংকট শুধু চিকিৎসার নয়, মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক চাপ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।"
দেশে জনসংখ্যাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর আনুমানিক ৬-৮ হাজার নতুন থাইরয়েড ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "রেডিওআয়োডিন আইসোটোপ সংকটের বিষয়ে আমরা জেনেছি। যদিও এই ওষুধ আমদানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয়, তবে সমস্যাটি যেহেতু স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমরা দ্রুত সমাধানের জন্য পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করব।"
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন টিবিএসকে বলেন, "অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে খোঁজ নিয়েছি। চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, বিকল্পভাবে চিকিৎসা চালানো হচ্ছে, চিকিৎসায় বড় সমস্যা হচ্ছে না। একটি গ্রুপ আমদানিতে বাধা দিচ্ছে—সম্ভবত ব্যবসায়িক কারণে। তারা নিয়মের বাইরে গিয়ে ওষুধ কেনা-বেচার চেষ্টা করেছে। এ কারণে আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সমস্যা হয়েছে। দ্রুত এটি সমাধান করা হবে।