গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরে গোপনে আলোচনা চালাচ্ছে ইসরায়েল; মিশরকে চাপ, ৬ দেশকে প্রস্তাব

গাজা থেকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে স্থানান্তরিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। এ পদক্ষেপকে তারা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করলেও ইউরোপ ও আরব বিশ্বের সরকারগুলো একে অবাস্তব এবং আন্তর্জাতিক আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘন হিসেবে সমালোচনা করেছে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে এই ধারণা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন। তবে চলতি বছরের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একে আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পুনর্নির্মাণ করা এবং উপত্যকার বিশ লাখ বাসিন্দার অনেককে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। এ মন্তব্যের পর থেকেই ধারণাটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে।
সেই আলোচনা এখন কিছুটা স্তিমিত হলেও এই ধারণার সমর্থকরা এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা লিবিয়া, দক্ষিণ সুদান, সোমালিল্যান্ড ও সিরিয়াসহ প্রায় ছয়টি দেশ ও অঞ্চলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, যাতে তারা স্বেচ্ছায় গাজা ছাড়তে রাজি হওয়া ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করে।
কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, গাজার বাসিন্দাদের সিনাই উপদ্বীপে পুনর্বাসিত করার জন্য মিশরকেও চাপ দিচ্ছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। একসময় গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী মিশর এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। গাজার সঙ্গে সীমান্ত থাকায় এই পরিকল্পনার প্রবক্তাদের চোখে মিশর কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক গন্তব্য। এই চাপের জেরে বেশ কয়েকটি উত্তপ্ত বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে ইসরায়েলি ও মিশরীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচিও হয়েছে বলেও কিছু সূত্র জানিয়েছে।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি বলেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের জীবনমান উন্নত করার জন্য সৃজনশীল সমাধানের পক্ষে কথা বলেছেন, যার মধ্যে রয়েছে গাজা পুনর্নির্মাণের সময় তাদের একটি নতুন, সুন্দর জায়গায় পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া। তবে হামাসকে প্রথমে নিরস্ত্রীকরণ এবং এই যুদ্ধ অবসানে সম্মত হতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে দেওয়ার মতো আর কোনো বিস্তারিত তথ্য নেই।'

কিছু সূত্র জানিয়েছে, গাজাবাসীদের দক্ষিণ সুদান বা লিবিয়ায় পুনর্বাসনের বিষয়ে ইসরায়েলের আলোচনা এখনও চলছে। তবে সিরিয়া বা সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল সোমালিল্যান্ডে ফিলিস্তিনিদের বসতি স্থাপনের জন্য আগের আলোচনা তেমন কোনো অগ্রগতি লাভ করেনি বলে এক ব্যক্তি জানান।
যেসব গন্তব্য বিবেচনা করা হচ্ছে, তার বেশিরভাগেরই গৃহযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মতো নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। লাখ লাখ অভিবাসীকে আত্মীকরণ করতে ওইসব অঞ্চলকে হিমশিম খেতে হতে পারে। তবে তাদের এই দুর্বল অবস্থার কারণেই এমন চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ওই চুক্তির আওতায় গাজা বা অন্য কোথাও থেকে স্থানান্তরিত মানুষদের গ্রহণের বিনিময়ে তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা বা অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা মুষ্টিমেয় কিছু অভিবাসীকে দক্ষিণ সুদানে পাঠিয়েছে। পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়া অভিবাসীদের গ্রহণ করার জন্য চাপ দিয়েছে। কর্মকর্তারা বলেন, দক্ষিণ সুদান ফের ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। সে কারণেই তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত অভিবাসীদের গ্রহণে এবং ফিলিস্তিনিদের গ্রহণের বিষয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করেছে।
স্থানান্তরের বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। আইনি সংস্থা, মানবাধিকার গোষ্ঠী ও কিছু সরকার প্রশ্ন তুলেছে, এই স্থানান্তর প্রকৃতপক্ষেই স্বেচ্ছায় হবে কি না। মালয়েশিয়া, জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অনেকেই সতর্ক করেছে, এই ধারণাটি জাতিগত নিধনের শামিল হতে পারে।
দক্ষিণ সুদানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলের সঙ্গে এ ধরনের আলোচনায় যুক্ত থাকার দাবি ভিত্তিহীন। সোমালিল্যান্ড সরকারের একজন প্রতিনিধি বলেন, কোনো আলোচনা চলছে না। লিবিয়া ও সিরিয়ার কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি।
বর্তমান ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনের বিষয়ে ইসরায়েল ও আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত ছিল না।
জুলাইয়ে হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, যেসব ফিলিস্তিনি গাজা ছাড়তে চান, তাদের জন্য আবাস খুঁজে বের করতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে।
ট্রাম্পের সামনে বসে নেতানিয়াহু বলেন, 'আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে এমন দেশ খুঁজে বের করতে কাজ করছি, যারা ফিলিস্তিনিদের উন্নত ভবিষ্যৎ দেওয়ার বিষয়ে তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী।'

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অনেক আগে থেকেই গাজা হতে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের পক্ষে কথা বলে আসছিলেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের এক সপ্তাহের মধ্যেই তৎকালীন ইসরায়েলি গোয়েন্দামন্ত্রী গিলা গামলিয়েল মন্ত্রিসভায় একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। মে মাসে এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ওই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল গাজা থেকে অভিবাসনকে উৎসাহিত করা, যাতে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ সেখান থেকে চলে যায়।
এই ধারণার সবচেয়ে উৎসাহী সমর্থক ছিলেন অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের মতো কট্টর-ডানপন্থি কর্মকর্তারা, যারা বছরের পর বছর ধরে এই পরিকল্পনার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন।
অক্টোবরে উপত্যকায় ইহুদি বসতি স্থাপনের জন্য আয়োজিত এক সম্মেলনে বেন-গভির বলেন, 'অভিবাসনকে উৎসাহিত করুন! অভিবাসনকে উৎসাহিত করুন! অভিবাসনকে উৎসাহিত করুন! সত্যি বলতে, এটাই সবচেয়ে নৈতিক এবং সঠিক সমাধান। জোর করে নয়, বরং তাদের বলুন: আমরা তোমাদের বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। ইসরায়েলের ভূমি আমাদের।'
ট্রাম্প যখন গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়ার ধারণাটি ঘোষণা করেন, নেতানিয়াহু ও তার সরকার সেটি মেনে নিয়ে প্রশংসা করে। ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ গাজাবাসীদের স্বেচ্ছায় প্রস্থানের বিষয়টি তদারকি করার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি নতুন বিভাগও প্রতিষ্ঠা করেন।
জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুতি একটি অপরাধ। ইসরায়েল এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই কনভেনশনের শর্তগুলো পূরণের মানদণ্ড অত্যন্ত কঠোর। এছাড়া গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবেশ এই স্থানান্তরকে স্বেচ্ছায় হচ্ছে বলে দাবি করার যুক্তিকে জটিল করে তোলে।
গাজায় এখন তীব্র খাদ্য সংকট। অনেকেই বাড়িঘর থেকে বাস্তুচ্যুত। বেশিরভাগ কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলের হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ৬১ হাজারের বেশি মানুষ।
এদিকে গাজার বহু ফিলিস্তিনি যুদ্ধের সময় চাইলেও এ ভূখণ্ড ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। কারণ মিশর ও ইসরায়েলের সীমান্ত পারাপারের পথগুলো কার্যত বন্ধ ছিল।