মোদির আমেরিকামুখী ঝোঁক ভারতকে যে বিপদে ফেলেছে

ভারত–মার্কিন সম্পর্ক এখন এমন এক জটিল ও চাপপূর্ণ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যা নয়াদিল্লির দীর্ঘদিনের কৌশলগত স্বনির্ভরতার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। একসময় যে সম্পর্ককে দুই দেশের পারস্পরিক কল্যাণে বিকশিত হতে থাকা অংশীদারিত্ব হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল—এখন সেটি কূটনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক হুমকি ও পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক শক্তি-সমীকরণের চাপে টানাপোড়েনে ভুগছে।
ভারত চারটি মৌলিক মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তি—লজিস্টিক্স এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব অ্যাগ্রিমেন্ট (লেমোয়া), কমিউনিকেশনস কমপ্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাগ্রিমেন্ট (কমকাসা), ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি অ্যানেক্স (আইএসএ) এবং বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (বেকা)—সই করে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের এক কৌশলগত মিত্র ও অংশীদার হিসেবে দাঁড় করায়।
কিন্তু এসব চুক্তি, এবং তার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়কার মার্কিন বাণিজ্যিক চাপ, ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে ধরে রাখার সক্ষমতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
জোট নিরপেক্ষতা থেকে কৌশলগত জোটে
স্নায়ুযুদ্ধকালে ভারতের জোট নিরপেক্ষতা নীতি দেশটিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমাদের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল; এতে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখেও কৌশলগত স্বনির্ভরতা রক্ষা সম্ভব হয়েছিল দিল্লির। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, চীনের উত্থান নিয়ে দিল্লি ও পশ্চিমা বিশ্বের যৌথ উদ্বেগ এবং বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার ভারতীয় আকাঙ্ক্ষা যুক্তরাষ্ট্রমুখী এক মোড় এনে দেয়।
এই পথে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল– ২০০৮ সালের মার্কিন-ভারত বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি, যা ভারতের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বৈধতা দেয়। যা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধির পদক্ষেপও ছিল।
২০১৭–২০২১ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় চুক্তি ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক গভীরতর হয়। এরপর জো বাইডেনের প্রশাসন ২০২৩ সালে ভারতকে যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন প্রযুক্তি হস্তান্তর সহজ করে।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে 'কোয়াড' জোটে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা এবং ২০১৬–২০২০ সালের মধ্যে চারটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর, মার্কিন কৌশলগত অক্ষে ভারতের অবস্থানকে দৃঢ় করে।
লেমোয়া পারস্পরিক লজিস্টিক সহায়তা, কমকাসা নিরাপদ যোগাযোগ, আইএসএ প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং বেকা ভূ-তথ্য বিনিময়ের উদ্দেশ্যে করা হয়। এসব চুক্তি ভারতের হাতে উন্নত মার্কিন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়, কিন্তু একইসঙ্গে এর সামরিক ও কৌশলগত কাঠামোকে ওয়াশিংটনের প্রভাববলয়ে বেঁধে ফেলে।
নরেন্দ্র মোদির সরকার একে চীনের মোকাবিলা ও ভারতের বৈশ্বিক মর্যাদা বৃদ্ধির পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু এই অ্যালাইনমেন্টের মূল্য দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। মোদি তথা ক্ষমতাসীন বিজেপির এহেন পররাষ্ট্রনীতিতে জোট নিরপেক্ষতার উত্তরাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এবং বিশেষত ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পড়ছে ভারত।
ট্রাম্পের ক্যারট অ্যান্ড স্টিক কৌশল
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ ছিল একপ্রকার মূলা ঝোলানোর কৌশল—প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, এবং ২০১৯ সালের "হাউডি মোদি" ইভেন্টের মতো কূটনৈতিক প্রদর্শনী।
এগুলো ছিল মূলত ভারতকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল কাঠামোয় টেনে আনার জন্য, যাতে চীনকে মোকাবিলা করা যায়। কোভিড-১৯ মহামারির সময় ট্রাম্প ভারতকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে চীন থেকে সরিয়ে ভারতে আনা হবে, কিন্তু বাস্তবে জেনারেল মোটরস, ফোর্ড ও হার্লে-ডেভিডসনের মতো প্রতিষ্ঠান ভারত ছেড়ে চলে যায়।
তবুও 'মজবুত বন্ধুত্ব'-এর কাহিনি প্রচার করা হয়েছিল ভারতের ঘরোয়া রাজনীতিতে। কিন্তু ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে কৌশল বদলে যায়—এবার আসে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক 'লাঠি'।
রাশিয়া থেকে ভারতের তেল ও অস্ত্র কেনাকে ট্রাম্প প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন; এবং ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করেছেন। ভারতকে রাশিয়া থেকে দূরে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি মানাতে এ চাপ প্রয়োগ হচ্ছে।
তিনি চান ভারত মার্কিন কৃষিপণ্যের জন্য তার বাজার উন্মুক্ত করুক—জিএম ভুট্টা, সয়াবিন, দুগ্ধজাত পণ্য ও ফল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করুক—যা ভারতের নিজস্ব কৃষিখাতের জন্য ক্ষতিকর। রাশিয়ার তুলনায় অনেক বেশি দামের মার্কিন তেল কিনতেও দিল্লিকে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
ট্রাম্প ভারতের অর্থনীতিকে "মৃত" বলে বিদ্রূপ করেছেন, ওষুধ রপ্তানিতে ১৫০–২৫০ শতাংশ শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছেন। অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের সামরিক বিমানে করে ফেরত পাঠিয়েছেন, এবং গত মে মাসের ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিরসনে মধ্যস্ততা করার যে দাবি করেছেন, সেটিও মোদির সরকারের জন্য বিব্রতকর। এমনকি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে মোদিকে এক নৈশভোজে যোগ দেওয়ারও আমন্ত্রণ জানান—যা মোদি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এছাড়া, ভিন্ন উপায়ও তার ছিল না।
এ যেন এক 'আমেরিকান এক্সসেপশনালিজম'-এর ধারা—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদেরও নিজের স্বার্থে অধীনস্ত রাখতে চায়। মোদি বুঝতে পারছেন না—আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব অনেকটা 'পরগাছার' মতো; যেখানে ভারতকে বড়জোর জুনিয়র পার্টনার হিসেবে দেখে ওয়াশিংটন।
মোদির পশ্চিমমুখী নীতি—যা ভারতের সামর্থ্যের অতিমূল্যায়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অবমূল্যায়নের উপর দাঁড়িয়ে আছে—দেশটিকে এক অনিশ্চিত ও দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে ভারতের জন্য জরুরি হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতির পুনঃসমন্বয়—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ককে ভারসাম্যপূর্ণ রাখা হবে, পাশাপাশি দেশীয় অর্থনৈতিক সংস্কারকে ত্বরান্বিত করা হবে।
এটি করতে ব্যর্থ হলে ভারত কার্যত এক "অধীনস্ত রাষ্ট্রে" পরিণত হবে, যা তার স্বাধীন বৈশ্বিক শক্তি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষাকে ভেঙে দেবে। এই পথচলায় প্রয়োজন কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, এবং বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে ভারতের অবস্থান নিয়ে একটি বাস্তবসম্মত ও ঠাণ্ডা মাথার পুনর্মূল্যায়ন।
লেখক: ভীম ভুর্তেল নেপাল ওপেন ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স প্রোগ্রামে ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স ও গ্লোবাল পলিটিক্যাল ইকোনমি পড়ান। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কাঠমান্ডুভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নবিষয়ক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক নেপাল সাউথ এশিয়া সেন্টার–এর নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার মূল বিশ্লেষণ থেকে এটি অনুবাদ ও পরিমার্জনা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।