নাইজারে পাওয়া মঙ্গলগ্রহের শিলা নিউইয়র্কে মিলিয়ন ডলারে বিক্রি, পাচারের অভিযোগ আফ্রিকার দেশটির

'নির্লজ্জ! একেবারেই বেপরোয়া কাজকারবার!'—শিকাগো থেকে ফোনে রাগে-ক্ষোভে আপত্তি জানালেন অধ্যাপক পল সেরেনো।
দুই বছর আগে পশ্চিম আফ্রিকার নাইজার দেশ থেকে উদ্ধার হওয়া একটি বিরল মঙ্গল গ্রহের শিলাবৃত্তির নিদর্শন গত মাস নিউইয়র্কে নিলামে বিক্রি হওয়ার সংবাদটি কানে পৌঁছানোর পর জীবাশ্মবিজ্ঞানী সেরেনো নিজের রাগ লুকিয়ে রাখতে পারেননি।
তিনি মনে করেন, এই শিলাটি নাইজারে ফিরে নিয়ে আসা উচিত।
মঙ্গলগ্রহের কোটি কোটি বছর পুরনো এই শিলাপিন্ডটি পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে বড় টুকরাগুলোর একটি। সথোবিস নিলামে এটি ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। তবে ক্রেতা ও বিক্রেতার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।
তবে এই অর্থের কোনো অংশ নিগারের কাছে গেছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
পৃথিবীতে এসে পৌঁছানো বহির্জাগতিক এই পদার্থের ভাঙা টুকরোগুলো দীর্ঘদিন ধরে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে—যার মধ্যে কিছু ধর্মীয় বস্তুরূপে গৃহীত হয়েছে, আবার কিছু জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব শিলার ওপর বৈজ্ঞানিক গবেষণাও বেড়েছে।
মেটিওরাইটের বাণিজ্যকে কখনো কখনো চিত্রকলা বাজারের সঙ্গে তুলনা করা হয়, যেখানে এর নান্দনিকতা এবং বিরলতা মূল্য নির্ধারণে প্রভাব ফেলে।
মঙ্গল গ্রহ থেকে পাওয়া এই বিরল শিলাটি প্রথম প্রকাশ পেলে সবাই বিস্মিত হয়। কারণ পৃথিবীতে পাওয়া ৫০ হাজার মেটিওরাইটের মধ্যে মাত্র চারশো'র নিচে মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা প্রমাণিত।
নিলামের সময় এই পাথরের ওজন ছিল ২৪.৭ কেজি। লাল আর রূপালি রঙের এই ঝকঝকে দৃষ্টিনন্দন পাথরটি দর্শকদের মন জয় করে।
কিন্তু এরপর প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, কীভাবে এই শিলা নিলামে পৌঁছালো? নাইজারের সরকার এক বিবৃতিতে এর রপ্তানির বৈধতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে এবং এর সম্ভাব্য অবৈধ আন্তর্জাতিক পাচারের বিষয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
তবে নিলাম প্রতিষ্ঠান সথোবিস এই অভিযোগকে পুরোপুরি অস্বীকার করে জানিয়েছে, সব প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। তবে নাইজার এখন ওই মেটিওরাইটের আবিষ্কার ও বিক্রির পরিস্থিতি তদন্ত করছে। মেটিওরাইটটির বৈজ্ঞানিক নাম 'এনডব্লিউএ ১৬৭৮৮' (এনডব্লিউএ মানে নর্থ-ওয়েস্ট আফ্রিকা)।
এই মেটিওরাইটটি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই নামকরা নিলাম কেন্দ্রে পৌঁছালো, সে সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া গেছে।

গত বছর প্রকাশিত একটি ইতালীয় একাডেমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ১৬ নভেম্বর ২০২৩ সালে নাইজারের আগাদেজ এলাকার সাহারা মরুভূমির কাছাকাছি, চিরফা ওয়াসিস থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে, এক 'মেটিওরাইট শিকারি' দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছিল। শিকারির পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
মেটিওরাইট পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় পড়তে পারে, কিন্তু সংরক্ষণের জন্য অনুকূল আবহাওয়া আর মানুষের কম উপস্থিতির কারণে সাহারা মরুভূমি মেটিওরাইট আবিষ্কারের অন্যতম প্রধান এলাকা। তাই অনেকেই এই কঠিন পরিবেশে মেটিওরাইট খুঁজে বিক্রির আশায় ঘুরে বেড়ান।
ইতালীয় প্রতিবেদনের তথ্য মতে, এনডব্লিউএ ১৬৭৮৮ স্থানীয় সম্প্রদায় থেকে আন্তর্জাতিক ডিলারের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল এবং পরে এটি ইতালির আগরেজো শহরের একটি ব্যক্তিগত গ্যালারিতে স্থানান্তরিত হয়।
ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের খনিজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জিওভান্নি প্রাতেসি নেতৃত্বাধীন বিজ্ঞানীদের একটি দল এই শিলাটি পরীক্ষা করে এর গঠন ও উৎস সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ পেয়েছিল। গত বছর এটি ইতালিতে অল্প সময়ের জন্য প্রদর্শিত হয়েছিল।
এরপর এটি গত মাসে নিউ ইয়র্কে প্রকাশ্যে দেখানো হয়। তবে শিলাটির দুই টুকরো ইতালিতে গবেষণার জন্য রাখা হয়।
সথোবিজ জানায়, এনডব্লিউএ ১৬৭৮৮ নিগার থেকে রপ্তানি করা হয়েছে এবং সমস্ত প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া অনুসারে পরিবহণ করা হয়েছে।
'আমরা যেকোনো পণ্য বিক্রির সময় যেমন সব ধাপের প্রয়োজনীয় দলিলপত্র সম্পূর্ণ রাখি, ঠিক তেমনই এটি থেকেও প্রত্যাশিত দেশগুলোর নিয়মাবলী মেনে চলা হয়েছে।'
সথোবিজের এক মুখপাত্র বলেন, তারা নাইজারের রপ্তানি সংক্রান্ত তদন্তের বিষয়ে অবগত এবং উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিবেচনা করে তাদের তথ্য পর্যালোচনা করছেন।
অন্যদিকে, প্রফেসর পল সেরেনো, যিনি দশ বছর আগে নাইজারে হেরিটেজ নামে একটি সংস্থা গঠন করেছিলেন, বিশ্বাস করেন নাইজারের আইন লঙ্ঘিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ''আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য—হোক সেটা সাংস্কৃতিক বস্তু, শারীরিক বা প্রাকৃতিক জিনিস, কিংবা বহির্জাগতিক পদার্থ—সরাসরি সেই দেশ থেকে নেওয়া যায় না। আমরা এখন ঔপনিবেশিক যুগ পেরিয়ে এসেছি, যখন এসব স্বাভাবিক মনে হতো।'
জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর অধীনে কয়েকটি বিশ্বব্যাপী চুক্তি এসব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। তবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ম্যাক্স গুনেলে'র ২০১৯ সালের গবেষণায় বলা হয়েছে, মেটিওরাইটের ক্ষেত্রে এসব চুক্তি প্রযোজ্য হবে কিনা তা নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এ অবস্থান স্পষ্ট করা রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব।
নাইজার ১৯৯৭ সালে তার নিজস্ব আইন পাস করে যার লক্ষ্য ছিল দেশের ঐতিহ্য রক্ষা করা।
প্রফেসর সেরেনো ওই আইনের একটি ধারার দিকে ইঙ্গিত করেন, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণির বস্তুসমূহের বিস্তারিত তালিকা রয়েছে। 'খনিজ বিজ্ঞান সম্পর্কিত নমুনা' শিল্পকলা, স্থাপত্য এবং পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত, তবে মেটিওরাইট বিশেষভাবে উল্লেখ নেই।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এত বড় ও চোখে পড়ার মতো এই নিদর্শনটি কীভাবে দেশের কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো।