চার্চিলের মন গলাতে অস্ট্রেলিয়ার পাঠানো প্লাটিপাস মারা যায় পথে; কেন? নাৎসি হামলা, অস্ট্রেলিয়ার অবহেলা…?

১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ডে এক জাহাজে করে পাঠানো হয় অত্যন্ত গোপন একটি উপহার—প্লাটিপাস, একটি বিরল প্রাণী, যার নাম ছিল নাম 'উইনস্টন'। খবর বিবিসি'র।
প্লাটিপাসটির নামকরণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নামে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে ব্রিটেনের প্রতি এই উপহারটি কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার অংশ ছিল।
তবে ইংল্যান্ড পৌঁছানোর আগেই 'উইনস্টন' মারা যায় তার জন্য তৈরি বিশেষ পানির ট্যাঙ্কে। উইনস্টনের মৃত্যুতে কূটনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে—এই ভয়ে ঘটনাটি গোপন রাখা হয়। পরে জানা যায়, উইনস্টনকে সংরক্ষণ করে রাখা হয় চার্চিলের ব্যক্তিগত অফিসে, কিন্তু মৃত্যুর আসল কারণ কী ছিল এতদিন সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
তবে সম্প্রতি এই ঘটনাকে নিয়ে নতুন অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, যা উইনস্টনের অকাল মৃত্যুর পেছনের কারণ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।
দুই উইনস্টন ও এক যুদ্ধের গল্প
প্লাটিপাস—ডিম পাড়া এক স্তন্যপায়ী যার হাঁসের মতো ঠোঁট, উটের মতো শরীর আর একটি লেজ রয়েছে। এত অদ্ভুত গড়নের প্রাণী দেখে একসময় অনেকে বিশ্বাস করতেন, এটি বুঝি ট্যাক্সিডার্মির মাধ্যমে তৈরি কোনো প্রতারণা।
তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের কাছে এটি ছিল বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। বিরল প্রাণীর সংগ্রাহক চার্চিল এমন ছয়টি প্লাটিপাস তার সংগ্রহে রাখতে চেয়েছিলেন।
১৯৪৩ সালে এই ইচ্ছার কথা তিনি অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ ভি ডক এভেটকে জানান। তবে এভেটের কাছে এটি শুধুমাত্র উপহার ছিল না, বরং একটি কূটনৈতিক কৌশল।
কারণ, সে সময় জাপানি আগ্রাসনের মুখে থাকা অস্ট্রেলিয়া মনে করছিল, 'মাদারল্যান্ড' ব্রিটেন তাদের পাশে নেই। যদি প্লাটিপাসের একটি দল চার্চিলের মন গলাতে পারে, তবে সেটাই হোক।
তবে সমস্যা ছিল—তখন অস্ট্রেলিয়া প্লাটিপাস রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল এবং এইতিহাসে কখনও এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কোনও প্ল্যাটিপাস বেঁচে পৌঁছায়নি। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এভেট বাধাগুলো অতিক্রমের মনস্থির করেছিল।
এই অভিযানের কাজে যাকে যুক্ত করা হয়, সেই সংরক্ষণবিদ ডেভিড ফ্লি এতটা আগ্রহী ছিলেন না। ১৯৮০ সালে তার বই প্যারাডক্সিক্যাল প্লাটিপাস-এ তিনি লিখেছেন, 'ইউরোপ-এশিয়ায় যখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তখন চার্চিলের মতো একজন মানুষ কীভাবে এত সময় বের করে এমন হাঁস-মুখো প্রাণীর কথা ভাবেন, শুধু ভাবেনই না—ছয়টি প্লাটিপাস চেয়ে বসেন! এটা ভাবতেও কষ্ট হয়।'

শেষ পর্যন্ত ফ্লে রাজনৈতিক চাপের মুখে ছয়টির পরিবর্তে মাত্র একটি প্লাটিপাস ইংল্যান্ড পাঠানোর সিদ্ধান্ত মেনে নেন। মেলবোর্নের নিকটবর্তী একটি নদী থেকে ধরা হয় সেই প্রাণী, যার নাম দেওয়া হয় 'উইনস্টন'।
উইনস্টনের জন্য তৈরি করা হয় এক বিশেষ 'প্ল্যাটিপুসারি'—ঘাসে মোড়ানো গর্ত, তাজা অস্ট্রেলীয় নদীর পানি, আর খাবারের তালিকায় প্রতিদিন ৫০ হাজার কেঁচো। উপরি পাওনা ছিল হাঁসের ডিম দিয়ে বানানো কাস্টার্ড। এমনকি তাকে দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত করা হয় একজন সহকারী, যিনি ৪৫ দিনের সমুদ্রযাত্রায় প্রাণীটির সব চাহিদা পূরণের দায়িত্বে থাকবেন।
প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে, পানামা খাল অতিক্রম করে আটলান্টিক পৌঁছানোর পথে ঠিক তখনই ঘটে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা।
পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এভেটকে একটি চিঠিতে চার্চিল প্লাটিপাস 'উইনস্টন'র মৃত্যুতে তার 'গভীর দুঃখ' প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, 'আপনারা আন্তরিকভাবে এটি পাঠিয়েছিলেন, সেটি আমি জানি। তবে এর মৃত্যু আমার কাছে বড় হতাশার বিষয়।'
পরবর্তীতে ধীরে ধীরে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ পেতে থাকে, যা দাবি করে, জাহাজটি নাৎসি জার্মানির একটি ইউ-নৌকার মুখোমুখি হয়েছিল, এবং বিস্ফোরণের আঘাতে কাঁপতে কাঁপতে মারা যায় ছোট্ট প্লাটিপাস উইনস্টন।
ছোট্ট এই প্লাটিপাসের ঠোঁট ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল—এমনকি নদীর তলদেশে রাতের অন্ধকারে মশার লার্ভার নড়াচড়াও অনুভব করতে পারত। এমন প্রাণী কীভাবে সহ্য করবে যুদ্ধের বিস্ফোরণ?
সংরক্ষণবিদ ডেভিড ফ্লে দশক পর তার বইতে লেখেন, 'যুদ্ধের দুর্ভাগ্য না হলে, একটি সুস্থ-সবল প্লাটিপাসই ইতিহাস গড়ত—ইংল্যান্ডের মাটিতে বসবাসকারী প্রথম প্লাটিপাস হিসেবে।'
এই রহস্য উদঘাটনের কাজ শুরু করেন পিএইচডি গবেষক হ্যারিসন ক্রফট। অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের বিভিন্ন আর্কাইভ ঘেঁটে তিনি খুঁজে পান জাহাজের ক্রুদের নানা দলিলপত্র। এমনকি মিলে যায় উইনস্টনের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সহকারীর এক সাক্ষাৎকারও।

হ্যারিসন ক্রফট বলেন, তারা উইনস্টনের মৃত্যুর পর একধরনের পোস্টমর্টেম করেছিল। সেই সহকারী স্পষ্টভাবে বলেছেন, জাহাজে কোনও বিস্ফোরণ হয়নি, সবকিছু শান্তই ছিল। কোনও হঠাৎ ঝাঁকুনি বা গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেনি।
হ্যারিসন ক্রফট যখন উইনস্টনের মৃত্যুর রহস্য অনুসন্ধান করছিলেন, তখন সিডনির অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়ামে ডেভিড ফ্লের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ঘিরে নতুন আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ফ্লে মৃত্যুর আগে তার সব নথি, ডায়েরি ও গবেষণালিপি এই জাদুঘরকে দান করেছিলেন।
সত্যি জানার জন্য সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ফ্লের সংগ্রহ ডিজিটালাইজেশনের কাজ শুরু হয়। লক্ষ্য ছিল, উইনস্টনের শেষ অধ্যায় নিয়ে কোনো অজানা তথ্য খুঁজে পাওয়া।
১৯৪০-এর দশকে প্লাটিপাসের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে মানুষ সচেতন ছিল। এমনকি উইনস্টনের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা করেছিল, সে যদি সুস্থ ইংল্যান্ড পৌঁছায়, তবে স্থানীয় কিশোরদের সাহায্যে কেঁচো সংগ্রহ করে খাওয়ানো হবে।
সিডনির শিক্ষার্থীরা যখন উইনস্টনের সহকারীর লগবুক পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আসে—জাহাজের যাত্রাপথে ধীরে ধীরে উইনস্টনের খাবারের পরিমাণ কমানো হচ্ছিল কারণ অনেক কেঁচো মারা যাচ্ছিল।
সবচেয়ে বড় সূত্র ছিল প্রতিদিন সকাল ৮টা এবং সন্ধ্যা ৬টায় তাপমাত্রার নথি। এই রেকর্ড থেকে স্পষ্ট হয়, যখন জাহাজ বিষুবরেখা অতিক্রম করছিল, তখন পানির তাপমাত্রা ছিল ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও উপরে—যা প্ল্যাটিপাসের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
৮০ বছরের বৈজ্ঞানিক গবেষণার আলোকে, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানান, উইনস্টনের শরীর এতটাই গরম হয়ে গিয়েছিল যে, সে কার্যত 'রান্না' হয়ে মারা গিয়েছিল।
তারা বলেন, সাবমেরিনের বিস্ফোরণে মৃত্যু হওয়ার গল্প একেবারে উড়িয়ে না দেওয়া গেলেও, শুধু দীর্ঘ সময়ের উচ্চ তাপমাত্রাই উইনস্টনের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল।
গবেষক ইওয়ান কোয়ান বলেন, 'জার্মান সাবমেরিনের ওপর দোষ চাপানো সহজ। কারণ আমরা ওকে ঠিকমতো খাওয়াইনি বা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি বলার চেয়ে সাবমেরিনের বিস্ফোরণে প্রাণীটা মারা গেছে, বলা সহজ।'
অন্য গবেষক পল জাকি যোগ করেন, 'ইতিহাস সবসময় নির্ভর করে—গল্পটা কে বলছে তার ওপর।'

দ্বিতীয় চেষ্টায় প্ল্যাটিপাস কূটনীতি: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব
প্রথম ব্যর্থতার পর অস্ট্রেলিয়া থেমে ছিল না। ১৯৪৭ সালে প্ল্যাটিপাস কূটনীতির দ্বিতীয় চেষ্টা শুরু হয়।
সংরক্ষণবিদ ডেভিড ফ্লে প্রথমবার বন্দি পরিবেশে প্লাটিপাস প্রজননে সফল হন, যা পরবর্তী ৫০ বছর কেউ করতে পারেনি।
এই সাফল্যের ভিত্তিতে ফ্লে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে রাজি করান যুক্তরাষ্ট্রের ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানায় তিনটি প্ল্যাটিপাস পাঠাতে—বেটি, পেনেলোপি ও সেসিল।
উইনস্টনের মতো গোপনীয়তা না রেখে, এই যাত্রা ছিল যাত্রা ছিল জনসম্মুখে, জমকালো আয়োজনে। প্ল্যাটিপাস তিনটি বোস্টনে পৌঁছলে উষ্ণ অভ্যর্থনা পায়। পরে এদের নিউইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত নিজে তাদের প্রথম কেঁচো খাওয়ান।
বেটি নিউইয়র্কে কয়েকদিনের মধ্যেই মারা গেলেও, পেনেলোপি ও সেসিল দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের দেখতে চিড়িয়াখানায় মানুষের ভিড় জমত। এমনকি তাদের জন্য বিয়ের পরিকল্পনাও শুরু হয়।
প্ল্যাটিপাস স্বভাবতই একাকী প্রাণী। তবুও নিউইয়র্কের ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানায় ছিল তাদের জন্য প্রেমের প্রতিশ্রুতি। ট্যাবলয়েডগুলো ছেপে চলছিল একের পর এক গল্প—কে কখন কী খেল, কে কার পাশে ঘুমাল, আর বিয়েটা কবে হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, পেনেলোপি যখন বাচ্চাদের অপেক্ষায় বাসা বাঁধছিল, তখন চার মাসের যত্ন ও অতিরিক্ত খাবারের পরেও বাচ্চার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষ পেনেলোপির বাসায় গেলে সেখানেই তাকে রাগান্বিত অবস্থায় পান। সন্দেহ করা হয়, সে গর্ভধারণের নাটক করছে এবং সেসিল থেকে দূরে থাকতে চায়।

প্রায় পাঁচ বছর পর, ১৯৫৭ সালে পেনেলোপি চিড়িয়াখানা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এক সপ্তাহের খোঁজাখুঁজি শেষে তাকে 'সম্ভাব্য মৃত' ঘোষণা করা হয়। এবং ঠিক এর পরদিন সেসিল মারা যায়।
এই দম্পতির মৃত্যু যেন প্লাটিপাস কূটনীতির শেষ অধ্যায়। ১৯৫৮ সালে ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানা আবারও কিছু প্ল্যাটিপাস নিয়ে চেষ্টা করলেও প্রাণীগুলো এক বছরের বেশি বাঁচতে পারেনি। এরপর থেকে অস্ট্রেলিয়া প্ল্যাটিপাস রপ্তানি কঠোরভাবে বন্ধ করে দেয়।
২০১৯ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া থেকে মাত্র দুটি প্ল্যাটিপাস বিদেশে পাঠানো হয়েছে, যা এখন সান ডিয়েগো চিড়িয়াখানায় রয়েছে।
এভাবেই প্লাটিপাস কূটনীতি শেষ হয়, আর উইনস্টনের পর এই বিরল প্রাণীর বিশ্বযাত্রার কাহিনি ইতিহাসের পাতায় বন্দী হয়ে থাকে।