১০০ বছরে লাইকা: ছোট্ট এক জার্মান ক্যামেরা যেভাবে চিরতরে বদলে দিয়েছিল ফটোগ্রাফির ইতিহাস

ভাবুন তো একবার সেই সময়ের কথা, যখন ছবি তোলা মানেই ছিল বিশাল, ভারী ক্যামেরার ঝক্কি আর স্টুডিওর চার দেওয়ালের সীমাবদ্ধতা। ঠিক একশ বছর আগে, ১৯২৫ সালের এক বসন্তে, এই ধারণাকেই আমূল বদলে দিতে জন্ম নিল ছোট্ট এক ক্যামেরা, যা ফটোগ্রাফির ইতিহাসে এক নিঃশব্দ বিপ্লব নিয়ে আসে।
জার্মানির লাইপজিগ মেলায় প্রথমবার জনসমক্ষে আসা সেই ক্যামেরাটির নাম ছিল 'লাইকা'। ৩৫ মিলিমিটার লেন্সের হ্যান্ডহেল্ড এই ক্যামেরাটি আকারে ছোট হলেও এর প্রভাব ছিল যুগান্তকারী। লাইকা কেবল একটি নতুন প্রযুক্তি ছিল না; এটি ছিল ফটোগ্রাফারদের জন্য স্বাধীনতার এক নতুন দিগন্ত। এই প্রথম তারা স্টুডিওর বাইরে এসে জীবনের চলমান মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরাবন্দী করার সুযোগ পেলেন। রাস্তা, উৎসব, যুদ্ধক্ষেত্র, সর্বত্রই লাইকা হয়ে উঠল ঘটনার সাক্ষী থাকার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম।
গত এক শতাব্দীতে প্রযুক্তির বহু পালাবদল ঘটেছে, কিন্তু লাইকার সেই বৈপ্লবিক আবেদন আজও অম্লান। পৃথিবীকে দেখার চোখ এবং গল্প বলার এক নতুন ভাষা তৈরি করেছিল এই ক্যামেরা। এই কিংবদন্তী ক্যামেরার শতবর্ষে ফিরে দেখা যাক সেই ইতিহাস, যা বদলে দিয়েছিল ফটোগ্রাফির ইতিহাস।
লাইকা আসার আগের ফটোগ্রাফি
লাইকা-১ আসার আগে ফটোগ্রাফি কেমন ছিল, সেটা বোঝা জরুরি। বিশ শতকের শুরুর দিকে ফটোগ্রাফি ছিল মূলত স্টুডিও নির্ভর বা কিছু আগ্রহী শৌখিন ফটোগ্রাফারের বিষয়। অধিকাংশ ক্যামেরা ছিল বড়সড়, জটিল, আর অনেক সময় গ্লাস প্লেট বা বড় ফিল্ম শিট ব্যবহার করত। ছবি তুলতে ট্রাইপড বসানো, ফ্রেম ঠিক করা আর নানা পরীক্ষা করে এক্সপোজার নেওয়া লাগত।
বহনযোগ্য ক্যামেরা তখনও ছিল যেমন কোডাক-এর বক্স ক্যামেরা বা ফোল্ডিং মডেলগুলো কিন্তু এসব সাধারণভাবে ছবি তোলার জন্য বানানো তবে সেগুলোর মান তেমন ছিল না। পেশাদাররা তখনও বড় ফরম্যাটের ক্যামেরা ব্যবহার করতেন, যেগুলো চটজলদি কাজের উপযোগী ছিল না।
তাই দরকার ছিল এমন এক ছোট, নির্ভরযোগ্য ও নিখুঁত ক্যামেরা, যেটা ফটোগ্রাফিকে স্টুডিওর দেয়ালের বাইরে এনে রাস্তায় নামাতে পারবে।
অস্কার বারনাক ও লাইকা-র জন্ম
লাইকা-র যাত্রা শুরু হয়েছিল কোনো ক্যামেরা কারখানায় নয়, বরং এক মাইক্রোস্কোপ গবেষণাগারে। জার্মানির ওয়েটজলার শহরের আর্নেস্ট লিটজ কোম্পানি তখন সম্মানজনক মাইক্রোস্কোপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ১৯১১ সালে সেখানে যোগ দেন এক প্রতিভাবান প্রকৌশলী অস্কার বারনাক। তার মূল দায়িত্ব ছিল সিনেমা ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির উন্নয়ন।
কিন্তু বারনাক শুধু প্রকৌশলী ছিলেন না, বরং একজন আগ্রহী শৌখিন ফটোগ্রাফারও। তবে ১৯১০-এর দশকে ফটোগ্রাফি ছিল শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য। বারনাক ছিলেন অ্যাজমার রোগী, তার জন্য বড় ক্যামেরা বয়ে বেড়ানো এক কঠিন কাজ। আর এখানেই তার শারীরিক দুর্বলতা হয়ে ওঠে ইতিহাস বদলে দেওয়া এক উদ্ভাবনের প্রেরণা।
১৯১৩ সালে তিনি একটি বিপ্লবী ধারণা দেন: কেন না ৩৫ মিলিমিটার মুভি ফিল্ম , যা আগে থেকেই সহজলভ্য তা এই ফিল্মই ব্যবহার করা হোক স্থিরচিত্র তোলার ক্যামেরায়? সাধারণ সিনেমা ক্যামেরা যেখানে ১৮x২৪ মিমি ফ্রেম ব্যবহার করত, বারনাক সেটিকে ঘুরিয়ে ২৪x৩৬ মিমি করেন। এই সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে আধুনিক ফটোগ্রাফির ভিত্তি।
এই ধারণা থেকে তৈরি হয় 'ইউআর-লাইকা' নামের প্রোটোটাইপ ক্যামেরা। এটা পকেটে রাখার মতো ছোট, তাতে ছিল একটি ভাঁজযোগ্য লেন্স আর নতুনভাবে তৈরি হরাইজন্টাল শাটার। একটি মূলত ছোট, শক্তিশালী, বহনযোগ্য ক্যামেরা, যেটি এক রিলে ৩৬টি ছবি তুলতে পারে।
কিন্তু ছোট ক্যামেরা বানানো ছিল প্রথম ধাপ মাত্র। বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এমন একটি লেন্স বানানো, যেটি ছোট নেগেটিভে সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট ছবি তুলতে পারে।
প্রথম ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরা সিস্টেম
বারনাক-এর তৈরি ছোট ক্যামেরা আর বেরেক-এর নিখুঁত লেন্স মিলে লাইকা হয়ে ওঠে ইতিহাসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ৩৫ মিলিমিটার স্থিরচিত্র ক্যামেরা সিস্টেম। এটি ছিল দ্রুত (তাতে ছিল ফাস্ট ফিল্ম অ্যাডভান্স), ছোট (সহজে লুকিয়ে ছবি তোলা যেত), আর ছবির ধার ছিল অসাধারণ। এলমার লেন্স হয়ে ওঠে লাইকা ব্র্যান্ডের পরিচায়ক, যার নকশা পরে বহু ভার্সন আর ফোকাল লেন্থে ছড়ায় । আজও এর কিছু সংস্করণ উৎপাদনে রয়েছে।
আসলে ক্যামেরা ও লেন্স একসঙ্গে বিকশিত হয়েছিল। বারনাক-এর যান্ত্রিক দক্ষতা আর বেরেক-এর অপটিক্যাল দক্ষতা মিলে তৈরি হয়েছিল এক দুর্দান্ত যুগল। এমনকি লাইকা-এম৩ আসার আগ পর্যন্ত এটি একই স্ক্রু-মাউন্ট, বদলযোগ্য লেন্স আর রেঞ্জফাইন্ডার ফোকাসের নীতি ধরে রাখে।

একটি বিপ্লবের সূচনা: ১৯২৫ সালের লাইপজিগ বসন্ত মেলা
১৯২৫ সালের মার্চে লাইপজিগ বসন্ত মেলায় জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করে লাইকা ১। "লিটজ ক্যামেরা" থেকেই এসেছে এর নাম। এটি ছিল অন্য সব ক্যামেরা থেকে আলাদা। এতে ছিল ৫০ মিলিমিটার f/৩.৫ এলমার লেন্স, ধাতব বডি, মাত্র ১৩৩ মিলিমিটার চওড়া। লেন্সটি ভাঁজ করা যেত, ক্যামেরায় ঢোকানো যেত বদলযোগ্য ফিল্ম ক্যাসেট, আর ছিল ১/২৫ থেকে ১/৫০০ সেকেন্ড পর্যন্ত শাটার স্পিড।
তবে এটি প্রথমে তেমন বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। দাম ছিল ৩২০ রাইখ্সমার্ক (আজকের দামে প্রায় ১,৪০০ মার্কিন ডলার)। তখন ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম দিয়ে স্থিরচিত্র তোলা মানুষের কাছে নতুন ধারণা ছিল। কিন্তু কিছু সাহসী ব্যবহারকারী যখন এটি দিয়ে দুর্দান্ত ছবি তুলতে শুরু করেন বিশেষ করে সাংবাদিকতা আর ভ্রমণচিত্রে তখন লাইকা-কে নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে।
জার্মান ছবি বিষয়ক ম্যাগাজিনে লাইকা নিয়ে প্রশংসায় ভরা প্রতিবেদন ছাপা হয়। বিদেশি সাংবাদিকরাও নজর দিতে শুরু করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পেশাদার ফটোগ্রাফাররাও এটি ব্যবহার করা শুরু করেন।
লাইকা-১ প্রমাণ করে এটি দ্রুত ছবি তুলতে পারে, যে কোনো জায়গায় নেওয়া যায়, আর সহজলভ্য ফিল্মে ঝকঝকে ছবি পাওয়া যায়। প্রথম বছরেই বিক্রি হয় ১,০০০ ইউনিট।
প্রযুক্তি কৃতিত্ব ও নকশা
লাইকা-১ কে ব্যতিক্রমী করে তোলে শুধু এর ছোট আকৃতি নয়, বরং প্রযুক্তি, ব্যবহারযোগ্যতা আর নির্ভরযোগ্যতার অসাধারণ সমন্বয়। ফিল্ম ট্রান্সপোর্ট ছিল সেই সময়ের তুলনায় অত্যন্ত উন্নত, যা ফিল্মকে শক্তভাবে ধরে রাখত। ছোট নেগেটিভে ধারালো ছবি পাওয়ার জন্য যা ছিল খুবই জরুরি। ৫০মিমি f/৩.৫ এলমার লেন্সটি ভাঁজ করা যেত, কিন্তু তখনকার তুলনায় অত্যন্ত শার্প ও কনট্রাস্টযুক্ত ছবি তুলত। শাটার ছিল হরাইজন্টাল ক্লথ কার্টেন ধরণের যা একদিকে নির্ভরযোগ্য, অন্যদিকে গতিশীল।
বারনাক শুধু একটি যন্ত্র তৈরি করেননি তার তৈরি ছিল এক সম্পূর্ণ সিস্টেম। লাইকা ছিল সহজ, ব্যবহারকারীবান্ধব, আর প্রয়োজন অনুযায়ী সম্প্রসারণযোগ্য। এটা ব্যবহারকারীর জীবনে সহজে মিশে যেতে পারত। কোটের পকেটে রাখা যেত, চুপিসারে ছবি তোলা যেত, আবার সহজে রিলোডও করা যেত।

৩৫ মিলিমিটারের উত্থান ও লাইকা-এর উত্তরাধিকার
১৯২০-এর শেষদিক থেকে ১৯৩০-এর শুরুর দিকে জেইস আইকন-এর মতো প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিজেদের ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরা তৈরি করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একসময় যাকে খুব ছোট বলে অবজ্ঞা করা হয়েছিল, সেই ফরম্যাট-ই হয়ে ওঠে ফটোজার্নালিজম, ডকুমেন্টারি আর ভ্রমণচিত্রের প্রিয় মাধ্যম।
লাইকা-১-এর পথ ধরে আসতে থাকে আরও উন্নত মডেল। ১৯৩২ সালে আসা লাইকা ২-তে যুক্ত হয় রেঞ্জফাইন্ডার, আর ১৯৩৩ সালের লাইকা ৩-এ আসে ধীরগতির শাটারসহ আরও কিছু টেকনিক্যাল উন্নয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত লাইকা ছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাস্তাঘাট, এমনকি বিজ্ঞানীদের হাতেও । লাইকা নতুন এক ধরণের ফটোগ্রাফিরও জন্ম দেয়। হালকা ও নিরব ক্যামেরা দিয়ে মুহূর্তের ছবি তোলা সহজ হয়, ফলে ফটোগ্রাফি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হেনরি কার্তিয়ার ব্রেসঁ, রবার্ট কাপা আর আলফ্রেড আইসেনস্ট্যাড এর মতো কিংবদন্তিরা লাইকা-কে জীবন্ত রূপ দেন। তারা বাস্তব জীবনের বিভিন্ন আবেগকে ক্যামেরাবন্দি করতে থাকেন, ছবিকে দিতে থাকেন এক নতুন গভীরতা।
আজকের লাইকা
২০২৫ সালের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, লাইকা ১-এর অনেক দিকই আজও টিকে আছে। ২৪x৩৬ মিমি ফরম্যাট, যাকে এখন "ফুল-ফ্রেম" বলা হয়, তা এখনো ডিএসএলআর ও ডিজিটাল ক্যামেরার মানদণ্ড। ৫০ মিমি লেন্স আজও 'নরমাল' লেন্স হিসেবে বিবেচিত, এবং সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত ফোকাল লেন্থও এটি।
এমনকি আজকের লাইকা ব্র্যান্ডও সেই উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। আধুনিক লাইকা ক্যামেরা হোক তা ফিল্ম কিংবা ডিজিটাল, সবই গড়া হয় মিনিমালিস্ট নকশা আর দৃঢ় গুণগত মানকে ঘিরে। আজকের ডিজিটাল লাইকা এম১১ প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তবুও মূল দর্শন একই , ছোট, নির্ভুল, নিরব, ও দীর্ঘস্থায়ী।

তবে লাইকা-১ আজ কেবল সংগ্রহের বস্তু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিল্ম ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ ফিরে আসায় এই প্রাচীন যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসাও ফিরে এসেছে। এখনো অনেক ফটোগ্রাফার পুরোনো লাইকা-১ দিয়ে ছবি তোলেন।
লাইপজিগে সাড়া ফেলে দেওয়া সেই ছোট ক্যামেরার আজ ১০০ বছর পূর্ণ হলো। লাইকা-১ ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্যামেরা, কেবল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার জন্য নয়, এটি ফটোগ্রাফিকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে।
এটি ফটোগ্রাফিকে সবার নাগালের মধ্যে নিয়ে আসছে। সাংবাদিক, শিল্পী, গল্পকারদের হাত খুলে দিয়েছে। ফটোগ্রাফির কৃত্রিমতা সরিয়ে এনেছে বাস্তবতা ও মুহূর্তের সৌন্দর্য।
এভাবেই বিংশ শতাব্দী হয়ে উঠেছিল 'ফটোগ্রাফির শতাব্দী',আর ক্যামেরা হয়ে উঠেছিল স্মৃতি, শিল্প ও সত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা