ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েও তেল আবিবের সাথে ব্যবসা করছে ২৮ দেশ

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান হামলা এবং সেখানে ছড়িয়ে পড়া তীব্র খাদ্য সংকটের জন্য ইসরায়েলের কঠোর নিন্দা জানিয়ে গত সপ্তাহে ২৮ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে সই করা দেশগুলোও হলো—অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, সাইপ্রাস, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মাসখানেক আগেই গাজায় দারিদ্র্য এবং দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার সতর্কবার্তা দিয়ে আসলেও, এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এই ২৮ দেশের মধ্যে কয়েকটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ফ্রান্স গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছে, সেপ্টেম্বর মাসে তারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে, যা ইসরায়েলকে ক্ষুব্ধ করেছে।
তবে সমালোচকেরা বলছেন, এসব বিবৃতির পেছনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। অনেক দেশ একদিকে যুদ্ধের নিন্দা জানালেও অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি বা এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি যা ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যা বন্ধে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

যেসব দেশ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেরই ইসরায়েলের সঙ্গে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থের বাণিজ্য রয়েছে।
২০২৩ সালের অবজারভেটরি অফ ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির তথ্য অনুযায়ী, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর ইসরায়েলের সঙ্গে আমদানি, রপ্তানি বা উভয় ক্ষেত্রে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি।
অর্থাৎ, এই দেশগুলো একদিকে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত রয়েছে।
শীর্ষ বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে রয়েছে গাড়ি ও অন্যান্য মোটরযান, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, টিকা এবং পারফিউম।
বিশেষ করে আয়ারল্যান্ড ইসরায়েল থেকে সবচেয়ে বেশি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আমদানি করে, যার পরিমাণ প্রায় ৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এটি আয়ারল্যান্ডের ইসরায়েল থেকে আমদানি করা পণ্যের একটি বড় অংশ।
অন্যদিকে, বিবৃতিতে সই করা দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ইসরায়েলে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে। ২০২৩ সালে ইতালির মোট রপ্তানি প্রায় ৩ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার ছিল, যার মধ্যে গাড়ির রপ্তানি ছিল ১১৬ মিলিয়ন ডলার।
বিবৃতি জারি করা দেশগুলোর মধ্যে আয়ারল্যান্ড ও স্পেন ২০২৪ সালে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং গাজায় ইসরায়েলের কর্মসূচির জোরালো প্রতিবাদ করেছে। তবু তারা ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে।
আরও সাতটি দেশ, যেগুলো এই বিবৃতিতে সই করেছে, তারা ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ঘোষণা পর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর মধ্যে সাইপ্রাস, মাল্টা ও পোল্যান্ড উল্লেখযোগ্য।
আইসল্যান্ড (২০১১), সুইডেন (২০১৪), নরওয়ে (২০২৪) এবং স্লোভেনিয়া (২০২৪) ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আর ফ্রান্সও জাতিসংঘ সাধারণ সভায় সেপ্টেম্বর মাসে একই ঘোষণা দেওয়ার কথা বলেছে।

বিবৃতির প্রতি ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রত্যাশিত।
বিবৃতিটিকে প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমরস্টেইন এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লেখেন, 'বিবৃতিটি বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং হামাসকে ভুল বার্তা পাঠায়।'
ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য করা ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য গাজায় 'তাৎক্ষণিক আগ্রাসনবিরতি' এবং 'সব বন্দীর শর্তহীন মুক্তির' দাবি করেছে। তারা যুদ্ধ ও ইসরায়েলের অবরোধ ও সাহায্য প্রতিবন্ধকতার ফলে সৃষ্ট ক্ষুধা সংকট নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছে।
গাজায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৯ হাজার ৮২১ জন নিহত এবং ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৭ জন আহত হয়েছে।
গাজায় ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক মনোযোগ বাড়তে থাকায় 'কৌশলগত বিরতি' ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। এই বিরতি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আল-মাওয়াসি, দেইর এল-বালাহ ও গাজার কিছু এলাকায় কার্যকর হচ্ছে, যা রবিবার থেকে শুরু হয়েছে।
তবে এই বিরতির মধ্যেও রবিবার ভোরে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৪৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় খাদ্যাভাব ও অপুষ্টিতে আরও ছয় জন মারা গেছে, যাদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এতে করে এই ধরনের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৩ জনে, যার মধ্যে ৮৭ জনই শিশু।