১৮ বছর ধরে বিরল চীনা টাইপরাইটারের খোঁজে এক অধ্যাপক

২০১০ সালে একবার লন্ডনে বেড়াতে গিয়েছিলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইতিহাসের অধ্যাপক টম মুলানি। সেখানে এক নারী তাকে একটি পুরোনো চীনা টাইপরাইটার দেখাতে চান। শিগগিরই তার বাড়িতে সংস্কার কাজ শুরু হবে, তাই যন্ত্রটির জন্য নতুন ঠিকানা খুঁজছিলেন তিনি।
মুলানির কৌতূহল তখনই জেগে উঠল। বিশ্বজুড়ে বিচিত্র সব জায়গা থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এশীয় ভাষায় টাইপিং করার যন্ত্রগুলোর একটি সংগ্রহ আছে তার, যা তিনি বেশ যত্ন নিয়েই সংরক্ষণ করেন।
বহু বছর ধরে তিনি এমনই এক যন্ত্র খুঁজছিলেন—এমন একটি চীনা টাইপরাইটার, যা দেখতে ছোট হলেও হাজার হাজার চীনা অক্ষর মুদ্রণ করতে সক্ষম।
ধাতব ফ্রেম আর লিভারযুক্ত এই টাইপরাইটারটির ওজন প্রায় ৫০ পাউন্ড। একসময় এমন যন্ত্রই ছিল টাইপিং প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ, অথচ এখন তা প্রায় বিলুপ্ত।
তিনি ভাবছিলেন, যদি এটিকে কেউ না রাখে, তবে কি এটি শেষমেশ জঞ্জালের স্তূপে পড়ে থাকবে?
এই চিন্তা থেকেই মুলানি টাইপরাইটারটিকে একটি স্যুটকেসে ভরে ক্যালিফোর্নিয়ায় নিয়ে আসেন।
ড. মুলানি প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন 'মিংকুয়াই' নামের এক বিশেষ টাইপরাইটারের খোঁজ। এটি তৈরি করেছিলেন ম্যানহাটনে বসবাসকারী এক চীনা ভাষাবিদ লিন ইউতাং। আজ পর্যন্ত এই টাইপরাইটারটির শুধুমাত্র একটি প্রোটোটাইপ তৈরি হয়েছিল।

সম্প্রতি ড. মুলানি বলেছেন, 'এই একমাত্র যন্ত্রটির জন্যই আমি অসংখ্য ফোন করেছি, বহুজনকে অনুসরণ করেছি। তবুও শতভাগ বিশ্বাস ছিল না যে এটি আর পাওয়া যাবে—আমি ভেবেছিলাম এটি চিরতরে হারিয়ে গেছে।'
২০০৭ সালে ড. মুলানির এই ধরনের অদ্ভুত যন্ত্র নিয়ে আগ্রহ জন্মায়। তখন তিনি চীনা অক্ষর ধ্বংসের বিষয়ে একটা বক্তৃতার প্রস্তুতি করছিলেন। সেই ভাবনায় তিনি অনেক গভীর চিন্তায় চলে যান।
চীনা ভাষায় প্রায় এক লাখ অক্ষর আছে বলা হয়। কিন্তু এর মধ্যে কয়েক শত অক্ষরের উচ্চারণ আর কেউ জানে না। পুরনো বইতে সেগুলো লেখা আছে, কিন্তু তাদের সঠিক উচ্চারণ বা মানে সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে।
ড. মুলানি ভাবছিলেন, যেভাবে ছাপা অক্ষর কোনো কিছু চিরস্থায়ী করে রাখে, তবুও কি একদিন সেগুলো ভুলে যাওয়া সম্ভব? তিনি ভাবেন, সব চীনা অক্ষর নিয়ে একটা টাইপরাইটার তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই কিছু অক্ষরই বেছে নিতে হয়, বাকিরা বাদ পড়ে যায়।
নিজেকে প্রশ্ন করেন—তিনি কি কখনো চীনা টাইপরাইটার দেখেছেন?
এরপর দুই ঘণ্টা ধরে ড. মুলানি অফিসের মেঝেতে শুয়ে বসে চীনা টাইপরাইটারের পুরনো পেটেন্ট নথিপত্র পড়ছিলেন। গত দেড় শতাব্দীতে ডজনখানেক টাইপরাইটার তৈরি হয়েছে। প্রতিটিই আলাদা একজন উদ্ভাবকের ধারণা ও পরিকল্পনা ছিল—কিভাবে হাজার হাজার অক্ষর এক যন্ত্রে রাখা যায় এবং সেটি ব্যবহার করা যায়।
ড. মুলানি তখন মুগ্ধ হয়ে পড়েন।
সেই সন্ধ্যায় তার চিন্তা ধীরে ধীরে মাসব্যাপী গবেষণা আর বছরজুড়ে চলা অনুসন্ধানে রূপ নেয়। চীনা টাইপরাইটার তখন তার ইতিহাস গবেষণার এক বিশেষ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
তিনি অচেনা মানুষদের ফোন করতেন, ভয়েসমেইলে বার্তা পাঠাতেন সম্ভাব্য সংগ্রাহকদের জন্য। ইন্টারনেটের ছিন্নভিন্ন সূত্র থেকে চেষ্টা করতেন খুঁজে বের করতে কারো কাছে কোনো টাইপরাইটার আছে কি না। এন্সেস্ট্রি ডট কম-এ খুঁজতেন যন্ত্রটির শেষ মালিকের পরিবারের সন্ধান। জাদুঘরেও ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন, 'আপনার কাছে চীনা টাইপরাইটার আছে কি?'
কখনো কখনো তিনি 'হ্যাঁ' উত্তর পেতেন।
ডেলাওয়ারের একটি বেসরকারি জাদুঘরে ছিল একটি আইবিএম-তৈরি চীনা টাইপরাইটার, এরকম যন্ত্র তৈরি হয়েছিল মাত্র দুই-তিনটি। সান ফ্রান্সিসকোর এক চীনা খ্রিস্টান চার্চ থেকে একবার তাকে জানানো হয়, তাদের কাছে একটা টাইপরাইটার আছে, যা তারা ফেলে দিতে চাচ্ছেন।
ড. মুলানি সেটি গ্রহণ করেন।

তারপর তিনি পৌঁছালেন ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলের কাছে, যেখানে এক ভদ্রলোক কয়েক দশক ধরে দুটি জাপানি টাইপরাইটার সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন—যেগুলো চীনা টাইপরাইটারের মতোই বিরল ও দুর্লভ।
ড. মুলানি ওই দুটি টাইপরাইটারও সংগ্রহ করেন। তখন তার মনে হচ্ছিল, এই যন্ত্রগুলো আর কত দিন বেঁচে থাকবে, আর এগুলোর পেছনের গল্প জানেন এমন মানুষও হয়তো কমেই আছেন।
তখন তিনি বুঝতে পারেন, হয়তো তিনিই শেষ ব্যক্তি, যে এই যন্ত্রগুলোকে ভুলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন।
চীনা টাইপরাইটার নিয়ে যারা জানেন, তাদের মধ্যে 'মিংকুয়াই' নামটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। এটির উদ্ভাবক লিন ইউতাং ১৯৩০-এর দশকে ভাবতে শুরু করেন, কালি আর তুলিতে লেখা চীনা অক্ষরগুলোকে সহজে পুনরায় ছাপার মতো করে না করতে পারলে, চীন প্রযুক্তির দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে—বা হয়তো বিদেশি শক্তির কাছে হারাবে।
তৎকালীন যেকোনো টাইপরাইটার উদ্ভাবনের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল—কিভাবে হাজার হাজার অক্ষর মাত্র একটি যন্ত্রে রাখা যাবে?
ড. লিনের সমাধান ছিল দারুণ অভিনব—একটি বড়সড় পশ্চিমা টাইপরাইটারের মতো দেখতে যন্ত্রের ভিতরে তিনি তৈরি করেছিলেন এক বিশেষ পদ্ধতি।
যেকোনো দুইটি কীস্ট্রোক, যন্ত্রের ভিতরে থাকা গিয়ারগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যেত। এরপর যন্ত্রের মাঝখানে একটি ছোট জানালা দেখা যেত—যাকে ড. লিন 'ম্যাজিক আই' নাম দিয়েছিলেন। ওই জানালায় আট ধরনের বিভিন্ন অক্ষর প্রদর্শিত হতো। টাইপরাইটার তখন সেখান থেকে সঠিক অক্ষর বেছে নিতে পারতেন।
ড. লিন মাত্র ৭২টি কী ব্যবহার করেই দশ হাজারের বেশি চীনা অক্ষর টাইপ করা সম্ভব করে দিয়েছিলেন। ড. মুলানির ভাষায়, এটা এমন এক কীবোর্ড ছিল, যা দিয়ে পুরো রোমান বর্ণমালা টাইপ করা যেত।
তিনি তার যন্ত্রটির নাম দিয়েছিলেন 'মিংকুয়াই', যার মানে 'স্বচ্ছ ও দ্রুত'।

সেসময় ড. লিন নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের আপার ইস্ট সাইডে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে থাকতেন। তিনি নিউ ইয়র্কের একটি যন্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিশাল খরচে একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করান।
তারপর তিনি টাইপরাইটার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেমিংটনের কর্মকর্তাদের সামনে সেই প্রোটোটাইপটি দেখান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যন্ত্রটি ঠিকমতো কাজ করেনি ।
ড. লিন দেউলিয়া হয়ে পড়েন, এবং প্রোটোটাইপটি বিক্রি হয়ে যায় ব্রুকলিনের একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান মেরগেনথেলার লিনোটাইপের কাছে।
এবং ড. মুলানির তথ্য অনুসারে, সেটিই ছিল যন্ত্রটির শেষ পরিচিত অবস্থান। ১৯৫০-এর দশকে মেরগেনথেলার লিনোটাইপ অফিস বদলালে, সেই মেশিনটি গায়েব হয়ে যায়।
২০১৭ সালে প্রকাশিত তার বই 'দ্য চায়নিজ টাইপরাইটার'-এ ড. মুলানি লিখেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন মিংকুয়াই সম্ভবত স্ক্র্যাপহিপে পড়ে গেছে। সেই যন্ত্রের গল্প বলার, বাঁচানোর জন্য সঠিক মানুষ তখন সেখানে ছিল না।
গত জানুয়ারিতে, নিউ ইয়র্কে নিজেদের বাড়িতে পুরাতন সব বাক্স ঘাটাঘাঁটি করছিলেন জেনিফার এবং নেলসন ফেলিক্স দম্পতি। জেনিফারের বাবা আরিজোনায় মারা যাওয়ার পাঁচ বছর আগে থেকে বাক্সটি তার সঞ্চয়ে ছিল।
হঠাৎ অন্যান্য কার্ডবোর্ড বাক্সের সাথে তারা এক কাঠের বক্সের দিকে চোখ যায় তাদের। নেলসন আগেই আরিজোনায় ওই বাক্সের ভেতর থেকে একটু ঝলক দেখেছিলেন। তিনি বললেন, 'ওহ, এটা সেই টাইপরাইটার।'
তিনি বাক্সটি খুলতেই বুঝতে পারলেন এটি সাধারণ কোনো টাইপরাইটার নয়। কী-গুলোর উপরে থাকা চিহ্নগুলো চীনা ভাষার মতো দেখাচ্ছিল।
নেলসন, যিনি প্রায়ই ফেসবুকে জিনিস কেনাবেচা করতেন, দ্রুত 'আমার এই টাইপরাইটারেরে এর দাম কত হতে পারে?' নামে একটি গ্রুপ খুঁজে পেয়ে কিছু ছবি পোস্ট করলেন।
এরপর তারা সেটিকে একটু পাশে রেখে অন্য কাজ এগিয়ে নিলেন। এক ঘণ্টা পরে, মি. ফেলিক্স তার পোস্টটি চেক করলেন।
সেখানে ছিল শত শত মন্তব্য, যার অনেকগুলো চীনা ভাষায় লেখা। মানুষজন বারবার 'টম' নামের কাউকে ট্যাগ করছিলেন।
জেনিফার এবং নেলসন একে অপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'টম কে?'
তখন ড. মুলানি শিকাগোতে একটি বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। তার ফোন বার বার পিং পিং করে বেজে উঠল।
যখন তিনি সেই পোস্ট দেখলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলেন এটা কী—মিংকুয়াই!
কিন্তু তিনি খুশি হলেন না। শান্তও ছিলেন না। উল্টো বেশ ভয় পেয়ে যান। তিনি জানতেন, এত বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া বলে ধরে নেওয়া এই যন্ত্রটি তার চোখের সামনে আবার ফিরে এসেছে।
কারণ তার মনে হয়েছিল—এত মূল্যবান একটি যন্ত্র যদি ভুল হাতে চলে যায়? যদি এটি আবার হারিয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, কিংবা এমন কেউ পেয়ে বসে যার কাছে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝার কোনো আগ্রহই নেই?
ড. মুলানির মনে হচ্ছিল, এই যন্ত্রটিকে বাঁচানো এখনও তার দায়িত্ব।
নেলসন শুরুতে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলেন—এই তো সামান্য একটা টাইপরাইটার, বছরের পর বছর বেজমেন্টে পড়ে ছিল।
কিন্তু ড. মুলানি তাকে প্রভাবিত করেছিলেন। 'এটা তো অর্ধশতাব্দী ধরে হারিয়ে ছিল,' তিনি বললেন। 'আমরা চাইনা এটা আবার হারিয়ে যাক।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের কাছে এটা শুধুই একটা টাইপরাইটার। কিন্তু অন্যদের কাছে এটা ইতিহাস, একটা গল্প, একটা জীবন, এক অমূল্য ধন।'
ড. মুলানি পরে খুঁজে বের করেন, নেলসনের দাদা ডগলাস আর্থার জাং ছিলেন মেরগেনথেলার লিনোটাইপ কোম্পানির একজন যন্ত্র নির্মাতা। ধারণা করা হয়, প্রতিষ্ঠানটি যখন তাদের অফিস স্থানান্তর করে, তখনই তিনিই মেশিনটি বাড়িতে নিয়ে আসেন।
এরপর সেটি জেনিফারের বাবার হাতে যায়—যিনি দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিংকুয়াই নিজের কাছে রেখেছিলেন।

এই বছরের এপ্রিল মাসে ফেলিক্স দম্পতি সিদ্ধান্ত নেন—তারা টাইপরাইটারটি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিকে বিক্রি করবেন। এটি কিনে নেওয়া হয় একটি বেসরকারি দাতার সহায়তায়, অপ্রকাশিত অর্থের বিনিময়ে।
যখন এটি স্ট্যানফোর্ডের একটি গুদামে বাক্স থেকে বের করে মেঝেতে নামানো হয়, ড. মুলানি শুয়ে পড়েন সেটার পাশে, একেবারে চোখের সামনে।
এই ইতিহাসের অধ্যাপক তখন দেখতে পান, মেশিনটি কতটা জটিল আর সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিতে পূর্ণ—এমনটা তিনি আর কোনো টাইপরাইটারে দেখেননি। তিনি ভাবতে শুরু করেন, কোনো ইঞ্জিনিয়ার যদি তাকে সাহায্য করেন, তাহলে হয়তো বোঝা যাবে ১৯৪৭ সালে ড. লিনের মাথায় কী চলছিল, যখন তিনি এমন একটি যন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা চীনকে ভবিষ্যতের ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারে।
হয়তো ভবিষ্যতে তারা এর আরেকটি নতুন সংস্করণও তৈরি করতে পারবেন।
পেটের ওপর ভর দিয়ে মেঝেতে শুয়ে ড. মুলানি ভাবতে থাকেন—এই যন্ত্রের ভিতর কি আরও কিছু লুকানো আছে?