সীমান্তে তীব্র হয়েছে যুদ্ধ; কম্বোডিয়ায় থাইল্যান্ডের বিমান হামলা

থাইল্যান্ড গত বৃহস্পতিবার কম্বোডিয়াকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। দুই দেশের গোলাগুলিতে অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিমান হামলার জন্য এফ-১৬ বিমান পাঠায় থাইল্যান্ড।
গতকাল সকালে সীমান্তের একটি বিতর্কিত এলাকা নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়, যা দ্রুত হালকা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে পরবর্তিতে ভারী গোলাবর্ষণে রূপ নেয়। দুই পক্ষই সংঘর্ষ শুরু করার জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে।
এই বিরোধপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চলটি নিয়ে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। বৃহস্পতিবারের এই সশস্ত্র সংঘর্ষ ছয়টি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, যেগুলো একে অপরের থেকে ২০৯ কিলোমিটার (১৩০ মাইল) দূরে অবস্থিত।
এ যুদ্ধ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে থাইল্যান্ড ছয়টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে, যার মধ্যে একটি ব্যবহার করে কাম্বোডিয়ার সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়।
থাই সেনাবাহিনী জানায়, নির্ভুলভাবে আঘাত হানার জন্য তারা বিমান ব্যবহার করেছে। তবে কাম্বোডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই পদক্ষেপকে 'হঠকারী ও নিষ্ঠুর সামরিক আগ্রাসন' বলে আখ্যা দেয়।
গত ১৩ বছরে দুই দেশের মধ্যে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ।
বুধবার থাইল্যান্ড তার রাষ্ট্রদূতকে নম পেন থেকে ফিরিয়ে আনে এবং কাম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে। এর আগে এক থাই সেনা পায়ে পাতা মাইন বিস্ফোরণে পা হারান। থাইল্যান্ড দাবি করে, এই মাইন সম্প্রতি প্রতিপক্ষ সেনারা পুঁতে রেখেছিল। তবে কাম্বোডিয়া এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করে।
থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া সংঘাত নিয়ে আজ শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
থাইল্যান্ডের দীর্ঘদিনের চুক্তিভিত্তিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির জন্য দুই পক্ষের প্রতি তাৎক্ষণিক আহ্বান জানিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র টমি পিগট এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, 'আমরা থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া সীমান্তে ক্রমবর্ধমান সহিংসতায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবরে অত্যন্ত দুঃখিত।'
তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র সংঘর্ষের তাৎক্ষণিক অবসান, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংকটের সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে।'
গত মে মাসের শেষ দিকে এক সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষে একজন কাম্বোডিয়ান সেনা নিহত হওয়ার পর থেকে দুই দেশই সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এরপর থেকে উভয় পক্ষই সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে।
এই উত্তেজনা একটি পূর্ণমাত্রার কূটনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে, যা থাইল্যান্ডের নাজুক জোট সরকারের ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
থাইল্যান্ড জানিয়েছে, দেশটির তিনটি প্রদেশে সংঘর্ষে ১২ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১১ জনই বেসামরিক নাগরিক। নিহতদের মধ্যে একজন আট বছরের শিশুও রয়েছে। বৃহস্পতিবারের হামলায় আরও ৩১ জন আহত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে কাম্বোডিয়ায় কতজন হতাহত হয়েছে, তা নিশ্চিত নয়।
থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ভেচায়াচাই সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা এই হামলার নিন্দা জানাই—সংঘর্ষপূর্ণ এলাকার বাইরে স্পষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে… এটি শক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ না করার সামিল।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। কিন্তু যা ঘটেছে, তা ছিল উসকানিমূলক এবং আমাদের আত্মরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।'
'পরিকল্পিত সামরিক আগ্রাসন'
থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সোমসাক থেপসুথিন সাংবাদিকদের জানান, সুরিন প্রদেশে একটি হাসপাতাল গোলাবর্ষণের শিকার হয়েছে। তিনি এ হামলাকে 'যুদ্ধাপরাধ' হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, 'এটি একটি পরিকল্পিত সামরিক আগ্রাসনের অংশ।'
অন্যদিকে, চলমান সংঘর্ষে কতজন হতাহত হয়েছে বা কত মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে—সেসব বিষয়ে কাম্বোডিয়ার সরকার, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি পাকিস্তানকে পাঠানো এক চিঠিতে কাম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে 'উসকানিহীন এবং পূর্বপরিকল্পিত সামরিক আগ্রাসন' চালানোর অভিযোগ তুলেছেন এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের এই ঘটনায় নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
সংঘর্ষ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার পর, থাইল্যান্ডের গ্রামবাসীরা—বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা—ভয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে কংক্রিটের বাংকারে, যেগুলো বালুর বস্তা ও টায়ার দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশে আশ্রয় নেওয়া এক অজ্ঞাতপরিচয় নারী থাই পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিসকে বলেন, 'কত রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে? হিসেব রাখা অসম্ভব।' এ সময় পেছনে গুলির শব্দ ও বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, থাইল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী সিসাকেত প্রদেশে একটি গ্যাস স্টেশন থেকে ঘন কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠছে। সেখানে আগুন লাগার পর দমকল কর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন।
সংঘর্ষের জেরে থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ৪০ হাজারের বেশি মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে। অনেককে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে, যেখানে বয়স্ক ও শিশুরা মাদুরে বসে আছে। এ সময় সরকারি কর্মীরা খাবার রান্না করছেন এবং ট্রাক থেকে খাবার ও বোতলজাত পানি নামিয়ে দিচ্ছেন।
সুরিন প্রদেশের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা সুপাপ ওংওয়াই বলেন, 'আমি আমার সন্তানদের নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। ওরা ভয়ে কাঁদছে।'
দশকের পর দশক ধরে চলা বিরোধ
থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়া দীর্ঘদিন ধরে তাদের ৮১৭ কিলোমিটার (৫০৮ মাইল) স্থলসীমান্তের বিভিন্ন অস্পষ্ট অংশ নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এই বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রাচীন হিন্দু মন্দিরগুলো, বিশেষ করে তা মোয়ান থম এবং ১১শ শতাব্দীর প্রেয়া বিহার মন্দির।
১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত প্রেয়া বিহার মন্দিরের মালিকানা কাম্বোডিয়াকে প্রদান করলেও, ২০০৮ সালে কাম্বোডিয়া যখন মন্দিরটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা করে, তখন নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়।
এর পরের কয়েক বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ হয় এবং এতে অন্তত এক ডজন মানুষ প্রাণ হারায়।
চলতি বছরের জুন মাসে কাম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) কাছে থাইল্যান্ডের সঙ্গে চলমান সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির অনুরোধ জানায়। তবে থাইল্যান্ড জানায়, তারা আদালতের এখতিয়ার স্বীকার করে না এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে চায়।
থাইল্যান্ডের যুদ্ধবিমান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত দেশটির সামরিক শক্তির প্রাধান্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে—বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের পরিমাণ ও সক্ষমতার দিক থেকে থাইল্যান্ড অনেক এগিয়ে।
এই সংঘর্ষে গোটা অঞ্চলেই উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম উভয়েই সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে, আর চীন সংঘাত প্রশমনে সহায়তা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।