গাজায় ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের ‘অমানবিকভাবে হত্যায়’ ইসরায়েলের প্রতি নিন্দা ২৮ দেশের

গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যসহ ২৮টি দেশ। তারা বলেছে, সেখানে বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে পৌঁছেছে। খবর বিবিসি'র।
এক যৌথ বিবৃতিতে এসব দেশ ইসরায়েলের ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থাকে 'বিপজ্জনক' বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা 'ধীরগতির ত্রাণ বিতরণ' ও 'খাদ্য-পানির জন্য অপেক্ষমাণ মানুষদের অমানবিকভাবে হত্যা' করারও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সপ্তাহের শেষে খাবারের জন্য অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় ইসরায়েলি হামলায় ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অপুষ্টির কারণে আরও ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তবে এসব সমালোচনার জবাবে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিটিকে 'বাস্তবতা বিবর্জিত' বলে দাবি করেছে। তারা বলেছে, এ ধরনের বক্তব্য হামাসকে ভুল বার্তা দিচ্ছে।
ইসরায়েলের অভিযোগ, হামাস মিথ্যা ছড়িয়ে ত্রাণ বিতরণে বাধা দিচ্ছে এবং এখনও যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময়ের কোনো প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছে না।
গত ২১ মাস ধরে চলা গাজা যুদ্ধ নিয়ে নানা সময় আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও এবারের বিবৃতিটি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে, কারণ এতে ২৮টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি সই করেছেন। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড।
বিবৃতির শুরুতেই বলা হয়, 'গাজায় যুদ্ধ এখনই শেষ হওয়া উচিত।'
তারা আরও বলেছে, 'বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ইসরায়েলের ত্রাণ বিতরণ পদ্ধতি বিপজ্জনক, এটি অস্থিরতা বাড়ায় এবং গাজার জনগণের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে।'
বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, 'আমরা ধীরগতির ত্রাণ বিতরণ এবং খাদ্য ও পানির জন্য অপেক্ষমাণ সাধারণ মানুষ— এমনকি শিশুরাও— যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তার নিন্দা জানাই। ইতোমধ্যে ৮০০-র বেশি ফিলিস্তিনি ত্রাণ নিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন, এটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।'
এর পরদিন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি পার্লামেন্টে বলেন, গাজায় 'ভয়াবহতার পর ভয়াবহতা' ঘটছে। এমনকি 'ক্ষুধার্ত ও মরিয়া শিশুরাও' ইসরায়েলি হামলার শিকার হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে গাজার জন্য অতিরিক্ত ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড মানবিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ল্যামি। তিনি বলেন, 'আমি ইসরায়েলের নিরাপত্তার পক্ষে, কিন্তু তাদের সরকারের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিরাপত্তাও দুর্বল করে দিচ্ছে।'
গত মে মাসে ১১ সপ্তাহের অবরোধ আংশিক শিথিল করার পর থেকে গাজায় খাদ্যসামগ্রীর জন্য অপেক্ষায় থাকা ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর খবর প্রায় প্রতিদিনই আসছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গাজায় চালু হয় নতুন ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা— 'গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন' বা জিএইচএফ। এ ব্যবস্থায় মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীরা ইসরায়েলি সামরিক এলাকায় থেকে খাদ্য বিতরণ করছেন। ইসরায়েলের দাবি, এতে হামাস ত্রাণ লুট করতে পারছে না।
তবে জাতিসংঘ ও তাদের অংশীদার সংস্থাগুলো এই ব্যবস্থায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাদের মতে, এটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং মানবিক সহায়তার নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, জিএইচএফ চালুর পর আট সপ্তাহে তাদের ত্রাণকেন্দ্রগুলোর আশপাশে ৬৭৪ জন এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার ত্রাণবহরের রুটে ২০১ জন নিহত হয়েছেন।
গত শনিবার খান ইউনুস ও রাফাহর দুটি জিএইচএফ কেন্দ্রের কাছে আরও ৩৯ জন নিহত হন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা সন্দেহভাজনদের কাছে আসা ঠেকাতে গুলি চালায়।
রবিবারও উত্তরের একটি সীমান্ত পয়েন্টে জাতিসংঘের ত্রাণবহরের দিকে ধেয়ে আসা জনতার ওপর গুলি চালানো হয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এতে ৬৭ জন নিহত হন। ইসরায়েল বলেছে, তারা 'তাৎক্ষণিক হুমকি' ঠেকাতে সতর্কতামূলক গুলি চালায় এবং হতাহতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে।
এরপর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে জানায়, গাজায় খাদ্যসংকট 'মরিয়া পর্যায়ে' পৌঁছেছে। সংস্থাটি বলেছে, 'মানুষ এখন মানবিক সহায়তার অভাবে মারা যাচ্ছে। অপুষ্টির হার মারাত্মকভাবে বাড়ছে। ৯০ হাজার নারী ও শিশু জরুরি চিকিৎসার অপেক্ষায় রয়েছে।'

সোমবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, শনিবার থেকে অপুষ্টিতে আরও ১৯ জন মারা গেছেন। তারা সতর্ক করেছে, সামনে 'গণহত্যার মতো' পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
দেইর আল-বালাহর আল-আকসা হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. খলিল আল-দাকরান বলেন, 'হাসপাতালগুলোতে রোগী বা কর্মীদের খাওয়ানোর মতো কিছু নেই। অনেকে এতটাই ক্ষুধার্ত যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।'
তিনি আরও জানান, 'ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য এক বোতল দুধও নেই। বাজারে শিশুখাদ্যের একেবারে ঘাটতি। সব শেষ হয়ে গেছে।'
এদিকে বাসিন্দারাও জানাচ্ছেন খাদ্যসংকটের ভয়াবহ চিত্র। এক সেলুনকর্মী ও দুই সন্তানের বাবা মোহাম্মদ ইমাদ আল-দিন বিবিসিকে বলেন, 'আমার সন্তানরা সারারাত ক্ষুধায় কাঁদে। গত তিন দিনে শুধু এক প্লেট ডাল খেয়েছে। রুটি নেই। এক কেজি আটার দাম এক সপ্তাহ আগে ছিল ৮০ ডলার।'
এমন প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল প্রস্তাব করেছে, গাজার ২১ লাখ মানুষকে দক্ষিণাঞ্চল রাফায় একটি তথাকথিত 'মানবিক শহরে' স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু যুক্তরাজ্যসহ ২৮টি দেশ একে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
তারা বলেছে, 'স্থায়ীভাবে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।'
বিবৃতিতে ইসরায়েল, হামাস ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, এই ভয়াবহ যুদ্ধ যেন অবিলম্বে, নিঃশর্ত এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে বন্ধ করা হয়।
তারা আরও জানিয়েছে, যুদ্ধ থামাতে ও শান্তির রাজনৈতিক পথ তৈরিতে তারা প্রয়োজনে আরও পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিবৃতিতে 'ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার' ইঙ্গিত রয়েছে। যদিও যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এখনও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন বলেছেন, 'এই যুদ্ধ শুরু করেছে হামাস। তারাই এখনো যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির কোনো চুক্তিতে রাজি হচ্ছে না। বরং তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে এবং ত্রাণ নিতে আসা সাধারণ মানুষদের বিপদের মুখে ফেলছে।'

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আগেই স্বীকার করেছে যে, ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের মাঝে হামলায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তারা বলছে, বেসামরিক জনগণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ কমাতে কাজ চলছে।
ইসরায়েলের ত্রাণ সমন্বয়কারী সংস্থা কোগাট জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ে ত্রাণ প্রবেশ নিশ্চিত করছে এবং সবকিছু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হচ্ছে।
অন্যদিকে, জিএইচএফ-এর মুখপাত্র চ্যাপিন ফে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এই ত্রাণ কার্যক্রমে যুক্ত হতে। তিনি জাতিসংঘের ওপর দোষারোপ করে বলেন, তারা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে এবং গাজার ভেতরে ত্রাণ পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সীমান্ত পয়েন্টে শত শত ত্রাণ ট্রাক পড়ে রয়েছে এবং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কারণ জাতিসংঘ তা গ্রহণ করছে না।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, রোববার পর্যন্ত প্রায় ৭০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক সীমান্তে অপেক্ষমাণ, যেগুলো জাতিসংঘ এখনো গ্রহণ করেনি।
জাতিসংঘ বলছে, চলমান যুদ্ধ, ইসরায়েলি বিধিনিষেধ এবং জ্বালানিসঙ্কটের কারণে তারা ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণে হিমশিম খাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১,২০০ জনকে হত্যা এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এখন পর্যন্ত সেখানে অন্তত ৫৯,০২৯ জন নিহত হয়েছেন।