দ্রুজ কারা; তাদের রক্ষায় কেন সিরিয়ায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল?

সিরিয়ায় আবারও প্রাণঘাতী সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়েছে। নতুন সরকার দেশজুড়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। খবর বিবিসি'র।
গত রোববার (১৩ জুলাই) দক্ষিণ সিরিয়ার সুয়েইদায় দ্রুজ সংখ্যালঘুদের এক ব্যবসায়ী অপহৃত হওয়ার ঘটনায় দ্রুজ মিলিশিয়া ও সুন্নি বেদুইন যোদ্ধাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়।
এরপর মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ইসরায়েল সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে। তারা জানায়, সুয়েইদায় দ্রুজদের রক্ষায় ও তাদের ওপর হামলাকারী সরকারপন্থিদের দমন করতেই এই অভিযান চালানো হয়েছে।
ব্রিটেনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, রোববার থেকে সুয়েইদায় সংঘর্ষে অন্তত ৩০০ জন নিহত হয়েছে।
সুয়েইদায় এটাই প্রথম বড় সংঘর্ষ নয়। এর আগে এপ্রিলে ও মে মাসে নতুন নিরাপত্তা বাহিনী ও দ্রুজ যোদ্ধাদের মধ্যে লড়াইয়ে বহু মানুষ নিহত হয়। তারও আগে, মার্চে দেশটির উপকূলীয় এলাকায় সংঘর্ষে বহু আলাউইত সংখ্যালঘু নিহত হন। এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
নতুন করে সহিংসতা ও ইসরায়েলের হামলার পর সিরিয়ায় আবারও নিরাপত্তাহীনতা ঘিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইসলামপন্থিদের হাতে দামেস্ক দখলের পর দেশটি আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
সিরিয়ার বর্তমান শাসক আহমেদ আল-শারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি দেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করবেন।
দ্রুজ কারা?
দ্রুজরা হলো আরবিভাষী এক জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, যারা সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল এবং ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান মালভূমিতে বসবাস করে। তাদের ধর্ম বিশ্বাস শিয়া ইসলামের একটি শাখা হলেও, এতে রয়েছে নিজস্ব পরিচয় ও বিশ্বাস।
বিশ্বে আনুমানিক ১০ লাখ দ্রুজ জনগোষ্ঠীর বাস, যাদের অর্ধেকই থাকে সিরিয়ায়। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ তারা।

ইসরায়েলে বসবাসরত দ্রুজদের অনেকে দেশটির সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। তাই সাধারণভাবে তারা ইসরায়েল-সমর্থক হিসেবে বিবেচিত হন। ইসরায়েলের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ও গোলান মালভূমিতে প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার দ্রুজ বাস করে।
সিরিয়ার রাজনীতিতে দ্রুজরা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থেকেছে। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সময় তারা দক্ষিণ সিরিয়ায় নিজেদের মিলিশিয়া গড়ে তোলে।
গত ডিসেম্বরে আসাদ সরকার পতনের পর থেকে দ্রুজরা দক্ষিণ সিরিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টার বিরোধিতা করছে। যদিও তারা নতুন সরকারের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব দেখাচ্ছে—কেউ সতর্ক, কেউ স্পষ্টভাবে বিরোধিতা করছে। তবে অনেকেই সুয়েইদায় সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি মানতে চায় না এবং সিরীয় সেনাবাহিনীতে যুক্ত না হয়ে স্থানীয় মিলিশিয়াদের ওপরই ভরসা রাখছে।
সিরিয়ার সরকার দ্রুজ জনগণের ওপর সাম্প্রতিক হামলার নিন্দা জানিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বললেও, তাদের বাহিনীর বিরুদ্ধেই দ্রুজদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা এসওএইচআরের তথ্য অনুযায়ী, সরকার বাহিনী দ্রুজদের 'সরাসরি গুলি করে হত্যা' করেছে। এসব ঘটনার কারণে দামেস্কের প্রতি কিছু দ্রুজের আস্থা কমে গেছে।

আসাদ সরকার হঠাৎ পতনের পর ইসরায়েল তার উত্তর সীমান্তের কাছাকাছি দ্রুজদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছে। তারা সিরিয়ার কুর্দি, দ্রুজ ও আলাউইত সংখ্যালঘুদের রক্ষাকারী হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছে। একইসঙ্গে তারা সিরিয়ার সামরিক ঘাঁটি ও সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত মে মাসে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চলাকালে ইসরায়েল দামেস্কে প্রেসিডেনশিয়াল প্রাসাদের কাছে হামলা চালায়। তারা বলে, এটি ছিল দ্রুজদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে একটি সতর্কবার্তা। তবে সিরিয়া ও লেবাননের কিছু দ্রুজ নেতা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেছেন, তারা (ইসরায়েল) নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় বিভাজন বাড়াচ্ছে এবং অঞ্চলজুড়ে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে।
কেন এখন সিরিয়ায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল?
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাগুলো মূলত সতর্কবার্তা এবং দক্ষিণ সিরিয়ায় সিরীয় সেনা মোতায়েন ঠেকানোর উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছে। ইসরায়েল ওই অঞ্চলে একটি নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল তৈরি করতে চায়। বিশেষ করে, তারা ভয় পাচ্ছে ইসলামপন্থি যোদ্ধারা ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান মালভূমির কাছে, উত্তর সীমান্তে অবস্থান নিতে পারে।
১৫ জুলাই ইসরায়েলি বিমান হামলা সীমিত ছিল, শুধু সুয়েইদায় নিরাপত্তা বাহিনী ও যানবাহনকে লক্ষ্য করা হয়। তবে ১৬ জুলাই তারা হামলা আরও বাড়ায়—দামেস্কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরেও আঘাত হানে। সিরিয়া এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরের এই হামলাগুলো ছিল সিরিয়ায় ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান। ওই সময় ইসরায়েল দেশজুড়ে শত শত সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল এবং জাতিসংঘ-পর্যবেক্ষিত গোলান মালভূমির একটি অঞ্চল দখল করে নেয়।

ইসরায়েল একাধিকবার সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে, যাতে নতুন সরকার সামরিক শক্তি গড়ে তুলতে না পারে। কারণ তারা এটিকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে।
১৬ জুলাই ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, 'দামেস্কে সতর্কবার্তা শেষ—এখন যন্ত্রণাদায়ক আঘাত আসবে।'
সিরিয়ার সেনা সদর দপ্তরে হামলার সময় একটি শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেল লাইভ সম্প্রচার করছিল। তাদের স্টুডিও ওই ভবনের সামনেই। সম্প্রচারের মাঝেই উপস্থাপককে স্টুডিও থেকে পালাতে দেখা যায়।
বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, সিরিয়ার সহিংসতা নিয়ে তারা 'চরমভাবে উদ্বিগ্ন'। ১৬ জুলাই তিনি জানান, 'আমরা কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপে একমত হয়েছি, যা আজ রাতেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে।'
লেবানন, ইরাক, কাতার, জর্ডান, মিসর ও কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশ সিরিয়ার সরকারি ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে 'ইসরায়েলের প্রকাশ্য আগ্রাসন' বলে মন্তব্য করেছে। ইরান বলেছে, এই হামলা ছিল 'অত্যন্ত প্রত্যাশিত'।
আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র তুরস্ক বলেছে, এই হামলা সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে 'একটি ষড়যন্ত্র'।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও সুয়েইদা ও দামেস্কে ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং একে উত্তেজনা বাড়ানোর পদক্ষেপ বলেছেন।

সামনে কী হতে পারে?
এই সহিংসতা সিরিয়ায় যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির নড়বড়ে অবস্থাকে আবারও সামনে এনে দিয়েছে। নতুন করে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আশঙ্কা বেড়েছে।
প্রেসিডেন্ট আল-শারা পুরো সিরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং বিভক্ত গোষ্ঠীগুলোকে একত্র করার চেষ্টা করছেন। তবে তার ইসলামপন্থি সরকার বহু বছরের গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করতে পারবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও ইসরায়েলি হামলা—দুটিই রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা ও যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনকে ব্যাহত করতে পারে।
ইসরায়েল এখনো দক্ষিণে নতুন কর্তৃপক্ষ ও তাদের ইসলামপন্থি মিত্রদের একটি বড় নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখছে। ফলে ইসরায়েল এমন গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোট গড়তে চাইতে পারে, যারা নতুন সরকারের কাছ থেকে উপেক্ষিত বা হতাশ।