ইসরায়েলের হামলায় নিহত ইরানের ৩ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা কারা

শুক্রবার ভোরে তেহরানে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েল বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায়। এই অভিযানটির নাম ইসরায়েল দিয়েছে 'রাইজিং লায়ন'।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানান, অপারেশনের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা ও সামরিক ক্ষমতা ধ্বংস করা।
এই অভিযানে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি ও সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি নিহত হয়েছেন। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন।
তাদের মৃত্যু দেশটির সামরিক মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান ১০০-র বেশি ড্রোন পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ।
ইসরায়েলের এই আক্রমণের ফলে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দেশটির পাল্টা প্রতিক্রিয়া সক্ষমতাও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে কেন এই তিন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের নিশানা করা হলো, এবং তারা কারা—সেই তথ্যগুলো জানা যাক।
মেজর জেনারেল হোসেন সালামী
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিশালি শাখা ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-র প্রধান হিসেবে মেজর জেনারেল হোসেন সালামী ছিলেন ইরানের অন্যতম শক্তিশালী ব্যক্তি। ২০১৯ সাল থেকে বাহিনীটির নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। সরাসরি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অধীন এই পদে থেকে সালামী দেশে-বিদেশে ইরানের নিরাপত্তা ও কৌশলগত তৎপরতা পরিচালনা করতেন।
ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক কর্মসূচিতে জড়িত থাকার জন্য ২০০০ সাল থেকে সালামীর ওপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে।
আইআরজিসির নেতৃত্বে থেকে তিনি ইরানের অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ দমন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।
সালামী ১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় প্রথম রেভল্যুশনারি গার্ডে যোগ দেন।
বাহিনীতে তার নেতৃত্বের সময়কালেই গত বছর ইরান ইসরায়েলের উপর প্রথমবারের মতো সরাসরি সামরিক আক্রমণ চালায়। ৩০০ টিরও বেশি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছিল ওই হামলায়।
ইসরায়েলের সাথে ক্রমশ উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে একদিন আগেই সালামি বলেছিলেন, 'যেকোনও পরিস্থিতির জন্য ইরান পুরোদমে প্রস্তুত'।
বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ ও অস্ত্রসহায়তা দিয়ে থাকে আইআরজিসি। এদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়।
হোসেন সালামীর নেতৃত্বে ইরান ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদেরও হুতি বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এই সহায়তার মাধ্যমে হুতিরা লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালানোর পাশাপাশি ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়ার সক্ষমতা অর্জন করে।
২০২৩ সালের এপ্রিল ও অক্টোবর মাসে ইরানের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে সরাসরি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। ওই দুটি হামলায় নেতৃত্বে ছিলেন সালামী।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, সালামী একটি ভূগর্ভস্থ সামরিক স্থাপনা পরিদর্শন করছেন, যেটি ওই হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে দাবি করা হয়।
সেখানে সবুজ সামরিক পোশাক পরা সালামীকে সেনাদের সালাম গ্রহণ করতে দেখা যায়। পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতাকা মাটিতে পাতা থাকলেও তা পায়ে মাড়িয়ে হেঁটে যান।
ইরানের আধা-সরকারি সংবাদমাধ্যম মেহর নিউজ জানায়, ওই স্থাপনায় 'নতুন ধরনের বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র' তৈরি করা হচ্ছিল।
২০১৯ সালে সালামীর নেতৃত্বে থাকা আইআরজিসি তেহরান থেকে ছেড়ে যাওয়ার পরপরই ইউক্রেনের একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে। এতে বিমানে থাকা ১৭৬ জন নিহত হন। পরে 'তোর এম-১' ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ইউনিটের এক নাম না-জানা কমান্ডারকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয় ইরান।
সিএনএনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক বেথ স্যানার বলেন, হোসেন সালামীর নিহত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের চিফ অব জয়েন্ট স্টাফসকে সরিয়ে দেওয়ার মতোই ঘটনা। তিনি বলেন, 'আপনি ভাবুন, এমনটা আমেরিকার সঙ্গে হলে তারা কী করত!'
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি
২০১৬ সাল থেকে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা আইআইএসএস-এর হিসাব অনুযায়ী, এই বাহিনীতে সক্রিয় সদস্য সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ ২০১৯ সালে বাঘেরির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাদের নথিতে বাঘেরিকে 'জেনারেল স্টাফ' হিসেবে উল্লেকখ করে বলা হয়, তিনি দেশটির সর্বোচ্চ সামরিক প্রতিষ্ঠান, এবং তিনি সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম সমন্বয় ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ওই নিষেধাজ্ঞার আওতায় বাঘেরিসহ সর্বোচ্চ নেতা খামেনির ঘনিষ্ঠ আরও ৯ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য, এরা দীর্ঘদিন ধরে ইরানের জনগণকে দমন, সন্ত্রাস রপ্তানি এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা সৃষ্টির নীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
২০১৭ সালে সিরিয়ার মাটিতে ইরানি সেনাদের সঙ্গে বাঘেরির সাক্ষাতের ছবি প্রকাশ করে ইরানের সংবাদমাধ্যম 'তাসনিম'।
চলতি বছরের এপ্রিলে তেহরানে বাঘেরির সঙ্গে বৈঠক করেন সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ শীতল সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল কোনো শীর্ষ সৌদি রাজপরিবারের সদস্যের বিরল সফর।
পরের মাসে রয়টার্স জানায়, ওই বৈঠকে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাঘেরিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন—যুক্তরাসষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরমাণু চুক্তির প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত, কারণ সেটিই ছিল ইসরায়েলের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধ এড়ানোর সুযোগ।
আলি শামখানি
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন আলি শামখানি। সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে চীন যে ঐতিহাসিক আলোচনার আয়োজন করে, তাতে ইরানের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন তিনিই।
শুক্রবার ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইএনএন।
২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এক দশক ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শামখানি। এর আগে তিনি ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন।
কূটনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। ওয়াশিংটন ও ইউরোপের পররাষ্ট্র মহলেও তার প্রভাব ছিল।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ তাকে নিরাপত্তা প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্লেষকদের মতে, শামখানি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তার অভিজ্ঞতার পরিসরও ছিল অনেক বড়। ২০০১ সালে তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাই হয়তো খামেনির অস্বস্তির কারণ হয়েছিল।
তবে পদ হারানোর পরও তিনি খামেনির কাছের মানুষ হিসেবে রয়ে যান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু আলোচনায় ফেরার সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
চলতি বছরের এপ্রিলেই তিনি সতর্ক করে বলেন, ইরান যদি হুমকি মনে করে, তাহলে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএ-র সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দিতে পারে এবং তাদের পরিদর্শকদের বের করে দিতে পারে।