ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত আলোকচিত্রী ফাতিমা, কান উৎসবে তাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র

'আমি যদি মরে যাই, আমার মৃত্যু যেন গর্জে ওঠে। আমি চাইনা আমার মৃত্যু সংবাদ শুধু একটি তাৎক্ষণিক সংবাদ হোক বা আমি শুধু একটি সংখ্যা হতে চাই না।'—২০২৪ সালে নিজের ইন্সটাগ্রাম প্রোফাইলে এমনটিই লিখেছিলেন ফিলিস্তিনি ফটোগ্রাফার ফাতিমা হাসুউনা।
যুদ্ধবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ফাতিমা হাসুউনা ১৮ মাস ধরে গাজার মাঠে-ঘাটে দৌড়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধ কভার করেছেন। আগামী কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার কথা ছিল তাকে নিয়ে তৈরি একটি তথ্যচিত্র। কিন্তু কাজটি আর দেখে যেতে পারলেন না ফাতিমা।
এ সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলায় পরিবারের আরও সাত সদস্যের সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে ফাতিমার।
সেদিনের ইন্সটাগ্রামে করা পোস্টটিতে তিনি আরও লিখেছিলেন, "আমি এমন মৃত্যু চাই যা গোটা বিশ্ব জানবে। যার প্রভাব যুগের পর যুগ থাকবে। আমি চাই এমন কিছু অমর ছবি, যেগুলো সময় কখনো মুছতে পারবে না।"
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুক্রবার সিএনএন-কে জানিয়েছে, বুধবারের ওই হামলায় ফাতিমা হাসুউনার বাবা-মা বেঁচে গেলেও দু'জনই মারাত্মক আহত হয়েছেন এবং বর্তমানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সুরক্ষা কেন্দ্র (পিজেপিসি) ফাতিমা হাসুউনার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, গাজা শহরের আল-নাফাক সড়কে ফাতিমার বাড়িতে ওই হামলা চালানো হয়। এতে তার পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য নিহত হন। সংস্থাটি এ হামলাকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে 'একটি অপরাধ' এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করেছে।
পিজেপিসি বিবৃতিতে বলেছে, "ফাতিমার শক্তিশালী ছবি অবরুদ্ধ জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরেছিল। এসব ছবি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়েছে। ছবিগুলো যুদ্ধের মানবিক ক্ষয়ক্ষতি বিশ্বের কাছে উন্মোচন করেছে।"
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) গত বুধবার জানায়, তারা হামাসের গাজা সিটি ব্রিগেডের একজন 'সন্ত্রাসী'কে চিহ্নিত করেছিল। বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
তারা আরও জানায়, "ওই সন্ত্রাসী আইডিএফ সেনা ও ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছে।" তবে তারা এ বিষয়ে আর কোনো বিস্তারিত তথ্য দেয়নি।
ফাতিমার কাজিন হামজা হাসুউনা শুক্রবার সিএনএন-কে ওই হামলার কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, 'আমি বসে ছিলাম, হঠাৎ করে দুটি রকেট এসে পড়ে—একটা আমার পাশে আরেকটা বসার ঘরে। পুরো বাড়িটা আমাদের ওপর ধসে পড়ে, চারপাশে শুধুই ধ্বংস আর বিভীষিকা।'
ফাতিমা তার তোলা ছবি ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করতেন, যেখানে তার অনুসারীর সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজারের বেশি। তার তোলা ছবি গাজার প্রতিদিনের জীবনের সংগ্রাম এবং ইসরায়েলি হামলার মধ্যে বসবাসের আতঙ্কের বাস্তবতা তুলে ধরত।

ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র 'পুট ইয়োর সউল অন ইয়োর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়াক'-এ ফাতিমার জীবনাচারকে তুলে এনেছেন ইরানি পরিচালক সেপিদে ফারসির। এই চলচ্চিত্রটি ২০২৫ সালের মে-তে হতে যাওয়া ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের এসিআইডি বিভাগে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। পরিচালক এক বিবৃতিতে চলচ্চিত্রটিকে 'একটি জানালা' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার ভাষায়, 'ফাতিমার কথা, ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যার দিককে জানালার মতো খুলে দিয়েছে।'
ফাতিমার মৃত্যুর খবর জানার পর শুক্রবার পরিচালক ফারসি সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবি শেয়ার করেন। ছবিটি ক্যামেরা হাতে হাস্যোজ্জ্বল ফাতিমার। ছবির পাশে তিনি লেখেন, 'তার শেষ চেহারাটা আমার মনে আছে—একটি হাসি। আজ আমি সেটাকেই আঁকড়ে ধরছি।'
শুক্রবার সিএনএন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেপিদে ফারসি বলেন, ফাতিমা হাসুউনা ছিলেন 'অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ, যার হাসি ছিল অসাধারণ এবং যার স্বভাবেই ছিল আশাবাদ।' পরিচালক জানান, ডকুমেন্টারিটি নিয়ে তিনি ফাতিমার সঙ্গে এক বছরেরও বেশি সময় কাজ করেছেন। এসময় আমরা একে অপরকে আরও ভালোভাবে জানতে শুরু করেছিলাম।
ফারসি জানান, মৃত্যুর ঠিক আগের দিনই ফাতিমা তাকে ডকুমেন্টারিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হওয়ার 'সুখবর' দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'আমরা আলোচনা করছিলাম, মে-তে সে আমার সঙ্গে ফ্রান্সে যাবে এবং কান উৎসবে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হবে। কারণ সে-ই ছিল চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্র।'
ফারসি আরও বলেন, 'তার মৃত্যুর খবর শুনে আমি ভেবেছিলাম এটা নিশ্চয়ই কোনো ভুল তথ্য।' তিনি আরও বলেন, "আমি আশা করি এই ডকুমেন্টারিটি গাজায় তার জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠবে এবং তার স্মৃতিতে একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি হয়ে থাকবে।"
পিজেপিসি-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় এখন পর্যন্ত মোট ২১২ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যেন এ ঘটনার একটি তাৎক্ষণিক তদন্ত শুরু করা হয় এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়।
ফাতিমার প্রতিবেশী উম আইদ আজুর জানান, ফাতিমা তার কাজ নিয়ে গর্বিত ছিলেন। তিনি ওই হামলার সমালোচনা করে বলেন, তাদের পরিবারের 'কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই'। তিনি বলেন, 'আমরা ৩৫ বছর ধরে একসঙ্গে প্রতিবেশী হিসেবে আছি, কখনও শুনিনি যে তাদের কোনো দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে।'
ফাতিমা হাসুউনার ফেসবুক পেজে তার সর্বশেষ পোস্ট ছিল গত শনিবার। সেদিন তিনি গাজা উপকূলে মাছ ধরার দৃশ্য তুলে ধরে একগুচ্ছ ছবি প্রকাশ করেন। তিনি ছবিগুলোর সঙ্গে একটি ছোট কবিতা লিখেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন, 'এখান থেকেই তুমি শহরটাকে চিনতে পারো। তুমি এতে প্রবেশ করো, কিন্তু আর বের হতে পারবে না—কারণ তুমি আর যেতে চাইবে না, কারণ যাওয়ার উপায়ও নেই।'