শনাক্ত ৭০, নিহত ১৯; বিরল ‘মস্তিষ্ক-খেকো’ রোগের বিরুদ্ধে লড়ছে ভারতের কেরালার মানুষ

ভারতের কেরালা রাজ্যের সবচেয়ে আনন্দের উৎসব হলো অনাম। সেই অনামের আগের রাতে ৪৫ বছর বয়সী সোভনা পড়ে ছিলেন একটি অ্যাম্বুলেন্সে। তিনি তখন কাঁপছিলেন, যেকোনো সময় তিনি অচেতন হয়ে পড়তে পারেন। এমন অবস্থায় তার পরিবার তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে আসে এমন এক ঘটনার চিত্র।
কয়েক দিন আগেও মালাপ্পুরম জেলার একটি গ্রামে ফলের রস বোতলজাত করে জীবিকা নির্বাহ করা এই দলিত (যাদের আগে 'অস্পৃশ্য' বলা হতো) নারী কেবল বলতেন তার মাথা ঘুরছে ও রক্ত চাপ বেড়ে আছে। ডাক্তাররা তাকে কিছু ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার দিনকে দিন অবনতি হতে থাকে: অস্বস্তি থেকে জ্বর, জ্বর থেকে প্রবল কাঁপুনি—আর অবশেষে ৫ সেপ্টেম্বর, উৎসবের দিনে সোভনার মৃত্যু হয়।
এর জন্য দায়ী ছিল নিগ্লেরিয়া ফাওলেরি—যা সাধারণভাবে 'মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা' নামে পরিচিত। এগুলো সাধারণত মিঠাপানিতে থাকে। এগুলো নাক দিয়ে প্রাণিদেহে শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। এটি এতটাই বিরল যে অনেক চিকিৎসক তাদের পুরো কর্মজীবনে এ ধরনের রোগের মুখোমুখি হন না।
নিহতের কাজিন ও সমাজকর্মী অজীথা কাথিরাদাথ বলেন, 'আমরা কিছুই করতে পারিনি। সোভনার মৃত্যুর পরই আমরা জানতে পারলাম এ রোগের কথা।'
এই বছর কেরালায় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ এই মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন এবং এর মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে তিন মাসের শিশু থেকে শুরু করে ৯২ বছর বয়সী বৃদ্ধও রয়েছেন।
সাধারণত উষ্ণ মিঠা পানিতে ব্যাকটেরিয়া খেয়ে বেঁচে থাকে এই এককোষী প্রাণী। কিন্তু এটি যখন নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে—সাধারণত সাঁতার কাটার সময়—তখন তা মস্তিষ্ক মারাত্মক এক সংক্রমণ সৃষ্টি করে, যার নাম প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগো এনসেফালাইটিস (পিএএম)। এ রোগ দ্রুত মস্তিষ্কের টিস্যু ধ্বংস করে ফেলে।
কেরালায় এই সংক্রমণ শনাক্ত হতে শুরু করে ২০১৬ সাল থেকে। সেসময় বছরে এক-দুইটির মতো এমন ঘটনা ধরা পড়তো। এখন পর্যন্ত প্রায় সব কেসই ছিল প্রাণঘাতী। একটি নতুন গবেষণায় জানা গেছে, ১৯৬২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে মাত্র ৪৮৮টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে এবং সেগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ায়। আক্রান্তদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু কেরালায় পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এখানে বেঁচে যাওয়ার হার বাড়ছে। গত বছর ৩৯ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন, মৃত্যুহার ছিল ২৩ শতাংশ। আর এ বছর প্রায় ৭০ জন আক্রান্ত হলেও মৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪.৫ শতাংশে। চিকিৎসকদের মতে, সংখ্যার এই বৃদ্ধি মূলে রয়েছে উন্নত ল্যাবরেটরির কল্যাণে রোগ শনাক্তকরণে অগ্রগতি।
থিরুবনন্তপুরম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান ডা. আরবিন্দ রেঘুকুমার বলেন, 'সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু মৃত্যুহার কমছে। আগেভাগে পরীক্ষা ও রোগ শনাক্তকরণই জীবন বাঁচানোর পথ খুলে দিয়েছে—যা কেরালার এক অনন্য কৌশল।'
তিনি আরও জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে রোগীর জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ও স্টেরয়েডের সমন্বিত ওষুধ প্রয়োগ করে এই অ্যামিবা সংক্রমণ থেকে রোগীকে বাঁচানো যায়।
বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪০০ ধরনের 'ফ্রি-লিভিং' অ্যামিবার প্রজাতি শনাক্ত করেছেন, তবে এর মধ্যে মাত্র ছয়টি মানুষের শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে নিগ্লেরিয়া ফাওলেরি ও আকানথামিবা, যেগুলো মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। কর্মকর্তাদের মতে, কেরালার জনস্বাস্থ্য ল্যাবগুলো এখন পাঁচটি প্রধান রোগজীবাণু অ্যামিবার ধরন শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
দক্ষিণ ভারতের এই রাজ্যটি ভূগর্ভস্থ পানি ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া অনেক পুকুর ও কূপ দূষিত। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর একটি ছোট গুচ্ছ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল কয়েকজন তরুণের মধ্যে, যারা সিদ্ধ করা গাঁজা পুকুরের পানি দিয়ে মিশিয়ে ভ্যাপ করছিল। এ ঘটনা দেখায় কীভাবে দূষিত পানি সংক্রমণের এক বিপজ্জনক বাহক হয়ে উঠতে পারে।
কেরালায় প্রায় ৫৫ লাখ কূপ এবং ৫৫ হাজার পুকুর রয়েছে—আর লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিনের পানির চাহিদা মেটান শুধুমাত্র কূপের পানি দিয়ে। এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় কূপ বা পুকুরকে কেবল 'ঝুঁকির উপাদান' বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না—এগুলোই আসলে রাজ্যের জীবনের মূলভিত্তি।
বিশিষ্ট মহামারীবিদ অনীশ টি এস বলেন, 'কেউ পুকুরে স্নান করার সময় আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ বা সুইমিংপুলে সাঁতার কাটার সময়। এমনকি নাক ধোয়ার জন্য পানি ব্যবহার করার মাধ্যমেও সংক্রমণ হয়েছে—যা একটি ধর্মীয় আচার। সেটা দূষিত পুকুর হোক বা কূপের পানি—ঝুঁকিটা বাস্তব।'
এ কারণে জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বৃহৎ পরিসরে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে। আগস্টের শেষ দিকে এক অভিযানে ২৭ লাখ কূপে ক্লোরিন দেওয়া হয়।
স্থানীয় সরকার পুকুরের চারপাশে সাঁতার ও স্নান নিষিদ্ধ করে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে এবং সুইমিংপুল ও পানির ট্যাংকে নিয়মিত ক্লোরিন দেওয়া নিশ্চিত করতে জনস্বাস্থ্য আইন কার্যকর করেছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ সত্ত্বেও বাস্তবে পুকুরে ক্লোরিন দেওয়া সম্ভব নয়—তাতে মাছ মারা যাবে। তাছাড়া তিন কোটির বেশি মানুষের এই রাজ্যে প্রতিটি গ্রামের পানির উৎস পর্যবেক্ষণ করাও কার্যত অসম্ভব।
এখন কর্মকর্তারা নিষেধাজ্ঞার চেয়ে সচেতনতাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। পরিবারগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ট্যাংক ও সুইমিংপুল পরিষ্কার রাখতে, নাক ধোয়ার ধর্মীয় আচার পালনে পরিষ্কার উষ্ণ পানি ব্যবহার করতে, শিশুদের বাগানের স্প্রিঙ্কলার থেকে দূরে রাখতে এবং অনিরাপদ পুকুর এড়িয়ে চলতে। সাঁতারুদের নাক সুরক্ষিত রেখে যেমন মাথা পানির ওপরে রেখে, নোজ প্লাগ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে আসল চ্যালেঞ্জ হলো জনসচেতনতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অযথা আতঙ্ক তৈরি না করা। অনিরাপদ মিঠা পানি ব্যবহারের প্রকৃত ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে, আবার এমন ভয়ও দেখানো যাবে না যাতে তাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়। অনেকে বলছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে নির্দেশিকা জারি থাকলেও এর বাস্তবায়ন এখনো খণ্ডিত ও অসংগত।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ ও কোষ জীববিদ্যার অধ্যাপক ডেনিস কাইল বলেন, 'এটি একটি জটিল সমস্যা। কিছু জায়গায় (যেমন উষ্ণ প্রস্রবণ) পানির উৎসে অ্যামিবার উপস্থিতির সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্কবার্তা টাঙানো হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি বাস্তবসম্মত নয়, কারণ অপরিশোধিত যেকোনো পানির উৎসেই—হ্রদ, পুকুর বা সুইমিংপুলে—অ্যামিবা থাকতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'যেসব পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও যথাযথ ক্লোরিনেশন নিশ্চিত করা সংক্রমণের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে সুইমিংপুল, স্প্ল্যাশ প্যাড এবং অন্যান্য কৃত্রিম বিনোদনমূলক জলকেন্দ্র।'
গবেষকরা সতর্ক করে বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। উষ্ণ পানি, দীর্ঘায়িত গ্রীষ্ম ও বাড়তে থাকা তাপমাত্রা অ্যামিবার বিস্তারের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে।
প্রফেসর অনীশের মতে, কেরালার উষ্ণমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলেও এটির বিস্তার ঘটতে পারে। দূষিত পানি এ ঝুঁকি আরও বাড়ায়, কারণ অ্যামিবা যে ব্যাকটেরিয়া খেয়ে বাঁচে, দূষণ তা বৃদ্ধি করে।
ড. ডেনিস কাইল সতর্ক করে বলেন, অতীতে কিছু ঘটনা হয়তো চিহ্নিতই হয়নি—অ্যামিবা যে সংক্রমণের কারণ, তা শনাক্ত করা যায়নি।
ড. ডেনিস কাইল ব্যাখ্যা করেন, নিগ্লেরিয়া ফাওলেরি সংক্রমণের চিকিৎসা কঠিন কারণ বর্তমান ওষুধের সংমিশ্রণ 'উপযুক্ত নয়'। যেসব রোগী খুব কমই বেঁচে যায়, তাদের ক্ষেত্রে একই চিকিৎসা প্রক্রিয়াই মানক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে পর্যাপ্ত তথ্য নেই এটি নির্ধারণ করার জন্য যে সব ওষুধই প্রকৃতপক্ষে কার্যকর বা প্রয়োজনীয়।
কেরালা আরও বেশি রোগী শনাক্ত করছে এবং আরও জীবন বাঁচাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোগের মানচিত্রকে পুনরায় লিখতে হতে পারে—এবং এমনকি সবচেয়ে বিরল রোগজীবাণুগুলোও দীর্ঘ সময়ের জন্য আর বিরল থাকতে নাও পারে।