বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০ কার্গো বিমান

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্গো বিমান হিসেবে পরিচিত অ্যানটোনভ এএন-২২৫ ম্রিয়া ধ্বংস হওয়ার আগপর্যন্ত হোস্টোমেল বিমানবন্দরে অবস্থান করত। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিমানটি ধ্বংস হয়ে যায়।
বিমানভিত্তিক কার্গো পরিবহন খাতে বোয়িং ৭৪৭-৮এফ এবং লকহিড সি-৫ গ্যালাক্সির মতো বিমানগুলোর আধিপত্য রয়েছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের মোট মূল্যমানের প্রায় ৩৫ শতাংশই পরিবাহিত হয় এ ধরনের বিমানে। এই কার্যক্রম পরিচালনায় জার্মানির লাইপজিগ/হালে বিমানবন্দর ও যুক্তরাষ্ট্রের টেড স্টিভেন্স অ্যানকারেজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বের বৃহৎ কার্গো বিমানগুলো সাধারণত মহাকাশ প্রযুক্তি, সামরিক সরঞ্জাম এবং জরুরি চিকিৎসা সহায়তা পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে স্নায়ুযুদ্ধকালীন তৈরি অ্যানটোনভ এএন-১২৪ কন্ডরের মতো বিমান, আবার রয়েছে আধুনিক যুগের বোয়িং ৭৪৭-৮এফ এর মতো ফ্রেইটার। প্রতিটি মডেলই এভিয়েশন প্রকৌশলের একেকটি যুগান্তকারী উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।
এখানে তুলে ধরা হলো এমনই ১০টি বিমান, যেগুলো আকার, বহনক্ষমতা এবং প্রযুক্তির দিক থেকে কার্গো পরিবহনে অনন্য:
- অ্যানটোনভ এএন-২২৫ ম্রিয়া
দৈর্ঘ্য: ৮৪ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ২,৫০,০০০ কেজি
ধরন: বাণিজ্যিক/সামরিক
উৎপত্তি: সোভিয়েত ইউনিয়ন (অ্যানটোনভ)
অ্যানটোনভ এএন-২২৫ ম্রিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ভারী ও দীর্ঘ উড়োজাহাজ, যা ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুরান স্পেস শাটল পরিবহনের জন্য নির্মিত হয়।
ছয়টি ইঞ্জিন এবং অতুলনীয় পেলোড ধারণক্ষমতা নিয়ে অ্যানটোনভ এএন-২২৫ ম্রিয়া ছিল এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এক বৈশ্বিক প্রতীক। এই উড়োজাহাজটি বাণিজ্যিক এবং মানবিক—দুই ধরনের মিশনেই ব্যবহৃত হতো।
অতিভারী ও অতিকায় মালামাল পরিবহনে এর দক্ষতা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়। বিশাল আকার ও শক্তির কারণে এটি বিমানপ্রেমী ও প্রকৌশলীদের কাছে ছিল এক অনন্য বিস্ময়।
তবে ২০২২ সালে ইউক্রেনে যুদ্ধের সময় সংঘর্ষে বিমানটি ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও এটি আর নেই, তবু এএন-২২৫ আজও সোভিয়েত যুগের প্রকৌশল উৎকর্ষ এবং বৈশ্বিক বিমান ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
- অ্যানটোনভ এএন-১২৪ রুসলান
দৈর্ঘ্য: ৬৯.১ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ১,৫০,০০০ কেজি
ধরন: সামরিক/বাণিজ্যিক
উৎপত্তি: সোভিয়েত ইউনিয়ন (অ্যানটোনভ)
স্নায়ুযুদ্ধের সময় তৈরি অ্যানটোনভ এএন-১২৪ রুসলান নির্মিত হয়েছিল বিশাল আকারের যন্ত্রপাতি, যানবাহন এমনকি অন্যান্য উড়োজাহাজ পরিবহনের উদ্দেশ্যে।
দৃঢ় কাঠামো ও ব্যতিক্রমী রেঞ্জের জন্য এই বিমানটি বৈশ্বিক সরবরাহ কার্যক্রমে বিশেষভাবে পছন্দের, বিশেষ করে দুর্গম ও দুর্যোগকবলিত এলাকায়।

বিমানটির সামনের অংশ ওপরে উঠিয়ে খোলা যায়, যা সহজে মালামাল উঠানো-নামানোর সুবিধা দেয়। যদিও এএন-২২৫ ম্রিয়ার ছায়ায় এর নাম কিছুটা ঢাকা পড়ে গেছে, তবুও ভারী পণ্য পরিবহনে এএন-১২৪ আজও অপরিহার্য। বহু আন্তর্জাতিক কার্গো বহরের অন্যতম ভরসা হিসেবে এটি এখনো সক্রিয়ভাবে ব্যবহার হচ্ছে।
- বোয়িং ৭৪৭-৮ ফ্রেইটার
দৈর্ঘ্য: ৭৬.৩ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ১,৩২,৬০০ কেজি
ধরন: বাণিজ্যিক
উৎপত্তি: যুক্তরাষ্ট্র (বোয়িং)
বোয়িং ৭৪৭-৮ ফ্রেইটার হলো বিখ্যাত ৭৪৭ সিরিজের সর্বশেষ ও সবচেয়ে বড় কার্গো সংস্করণ। এই বিমানটি দীর্ঘপথে পণ্য পরিবহনের জন্য অতুলনীয় রেঞ্জ ও বহনক্ষমতা প্রদান করে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যিক পরিবহনে একে অত্যন্ত কার্যকর করে তোলে। মহাদেশ পেরিয়ে দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য মালামাল পরিবহনে এটি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ফ্রেইটার।

উন্নত ইঞ্জিন ও আধুনিক নকশার কারণে বোয়িং ৭৪৭-৮ ফ্রেইটার পূর্ববর্তী মডেলগুলোর তুলনায় অনেক বেশি জ্বালানি সাশ্রয়ী। এতে রয়েছে সামনের দিক থেকে মালামাল ওঠানোর 'নোজ লোডিং' ব্যবস্থা এবং পাশের দিকেও কার্গো প্রবেশের সুবিধা, যা পণ্য লোডিংয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি নমনীয়তা নিশ্চিত করে।
ইউপিএস ও লুফথানসা কার্গোর মতো আন্তর্জাতিক লজিস্টিকস কোম্পানিগুলোর জন্য এই বিমানটি বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- লকহিড সি-৫ গ্যালাক্সি
দৈর্ঘ্য: ৭৫ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ১,২৭,৪৫৯ কেজি
ধরন: সামরিক
উৎপত্তি: যুক্তরাষ্ট্র (লকহিড মার্টিন)
লকহিড সি-৫ গ্যালাক্সি হলো বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক পরিবহন বিমানের একটি, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী পরিচালনা করে।
১৯৭০-এর দশকে চালু হওয়া এই বিমানটি ট্যাংক, হেলিকপ্টার এবং সেনাসহ বিশাল সরঞ্জাম বহনে সক্ষম। এর সামনের অংশ উঁচু করে খোলার 'নোজ-লিফট' প্রযুক্তি এবং পেছনের 'লোডিং র্যাম্প' দ্রুত পণ্য ওঠানো-নামানোর সুবিধা দেয়।

আকাশপথে জ্বালানি ভরার (এয়ারিয়াল রিফুয়েলিং) সুবিধা থাকায়, এটি কোনো বিরতি ছাড়াই মহাদেশ পেরিয়ে যাত্রা করতে পারে। এর উন্নত সংস্করণ 'সি-৫এম সুপার গ্যালাক্সি' এখনো সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা আগের তুলনায় বেশি নির্ভরযোগ্যতা ও পারফরম্যান্স নিশ্চিত করে।
- এয়ারবাস বেলুগা এক্সএল
দৈর্ঘ্য: ৬৩.১ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ৫০,৫০০ কেজি
ধরন: বাণিজ্যিক (অভ্যন্তরীণ শিল্প পরিবহন)
উৎপত্তি: ইউরোপীয় ইউনিয়ন (এয়ারবাস)
এয়ারবাস বেলুগা এক্সএল হলো পরবর্তী প্রজন্মের একটি পরিবহন উড়োজাহাজ, যা বিশেষভাবে বড় আকারের উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ—যেমন ডানা—একটি এয়ারবাস কারখানা থেকে অন্যটিতে পরিবহনের জন্য তৈরি করা হয়েছে।
বেলুগা তিমির অবয়ব অনুপ্রেরণায় তৈরি এই বিমানটিতে রয়েছে বিশাল কার্গো বেলি এবং উন্নত অ্যাভিওনিক্স সিস্টেম। আগের মডেলের তুলনায় এর ফিউজেলাজ লম্বা ও চওড়া, ফলে এটি আরও বেশি ওজন পরিবহন করতে সক্ষম এবং পরিবহন দক্ষতাও বেড়েছে।

যদিও এটি সাধারণ বাণিজ্যিক কার্গো পরিবহনে ব্যবহৃত হয় না, তবে এয়ারবাসের অভ্যন্তরীণ লজিস্টিকস ব্যবস্থায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২০১৯ সালে চালু হওয়া এই বিমানটি এয়ারবাসের ক্রমবর্ধমান উৎপাদন চাহিদা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, বিশেষ করে বড় ও সংবেদনশীল উড়োজাহাজ অংশসমূহ সময়মতো এবং নিরাপদে পৌঁছে দিতে।
- এয়ারবাস এ৩০০-৬০০এসটি বেলুগা
দৈর্ঘ্য: ৫৬.১৫ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ৪৭,০০০ কেজি
ধরন: বাণিজ্যিক (অভ্যন্তরীণ শিল্প পরিবহন)
উৎপত্তি: ইউরোপীয় ইউনিয়ন (এয়ারবাস)
বেলুগা এক্সএলের পূর্বসূরি এয়ারবাস এ৩০০-৬০০এসটি বেলুগা ১৯৯০-এর দশকে তৈরি করা হয়, বিশেষ করে এয়ারবাসের বিভিন্ন স্থাপনার মধ্যে বড় আকারের উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ পরিবহনের জন্য।
এর ফুলে ওঠা উপরের ফিউজেলাজ এবং অনন্য আকৃতি একে এভিয়েশন দুনিয়ায় পরিচিত করে তোলে। যদিও এটি মূল সেবা থেকে অবসর নিয়েছে, তবুও কিছু বেলুগা এখনো সীমিত পরিসরে পরিবহন কার্যক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বয়স সত্ত্বেও বিমানটি এখনও ব্যতিক্রমী আকারের মালামাল বহনে সক্ষম এবং এমন মিশনে ব্যবহৃত হয় যেখানে সাধারণ ফ্রেইটার উপযোগী নয়।
- অ্যানটোনভ এএন-২২ আনতেই
দৈর্ঘ্য: ৫৭.৯২ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ৮০,০০০ কেজি
ধরন: সামরিক
উৎপত্তি: সোভিয়েত ইউনিয়ন (অ্যানটোনভ)
অ্যানটোনভ এএন-২২ আনতেই হলো এখন পর্যন্ত নির্মিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় টার্বোপ্রপচালিত উড়োজাহাজ। ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য এটি তৈরি করা হয় ভারী সামরিক পরিবহন কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে।

বিমানটির অনন্য 'কনট্রা-রোটেটিং' প্রপেলারের ডিজাইন এবং মজবুত কাঠামো এটিকে অপরিকল্পিত রানওয়ে থেকেও উড্ডয়নে সক্ষম করে তোলে, যা দুর্গম এলাকায় মোতায়েনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
যদিও বর্তমানে এর অধিকাংশই সেবা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে, তবুও অল্প কয়েকটি এখনো সীমিত পরিসরে মানবিক সহায়তা বা বিশেষ মিশনে ব্যবহৃত হয়।
- বোয়িং ৭৪৭ ড্রিমলিফটার
দৈর্ঘ্য: ৭৬.৩ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ১,১৩,৪০০ কেজি
ধরন: বাণিজ্যিক (অভ্যন্তরীণ শিল্প পরিবহন)
উৎপত্তি: যুক্তরাষ্ট্র (বোয়িং)
বোয়িং ৭৪৭ ড্রিমলিফটার হলো ৭৪৭-৪০০ মডেলের একটি বিশেষ সংস্করণ, যা মূলত ৭৮৭ ড্রিমলাইনার কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিশালাকার উড়োজাহাজ অংশ—যেমন ফিউজেলাজ সেকশন ও ডানা—পরিবহনের জন্য তৈরি করা হয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কার্গো হোল্ড-সংবলিত এই উড়োজাহাজটি বড় যন্ত্রাংশ দ্রুত স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর 'সুইং-টেইল' নকশা বিশাল পণ্যের লোডিং আরও সহজ করে তোলে।
যদিও এটি সাধারণ বাণিজ্যিক কার্গো পরিবহনে ব্যবহৃত হয় না, তবে ২০০৬ সালে চালু হওয়া বোয়িংয়ের এ বিমান বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে একটি অপরিহার্য উপাদান।
- বোয়িং সি-১৭ গ্লোবমাস্টার থ্রি
দৈর্ঘ্য: ৫৩ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ৭৭,৫১৯ কেজি
ধরন: সামরিক
উৎপত্তি: যুক্তরাষ্ট্র (বোয়িং)
বোয়িং সি-১৭ গ্লোবমাস্টার থ্রি হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর জন্য নির্মিত একটি বহুমুখী সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ। সংক্ষিপ্ত এবং অপরিকল্পিত রানওয়ে থেকেও উড্ডয়ন ও অবতরণে সক্ষম এই বিমানটি কৌশলগত ও কৌশল-ভিত্তিক উভয় মিশনেই ব্যবহৃত হয়।

সি-১৭ ব্যবহৃত হয় সেনা পরিবহন, কার্গো ডেলিভারি, মেডিকেল ইভাকুয়েশন এবং মানবিক সহায়তার কাজে। উন্নত অ্যাভিওনিক্স ও উচ্চ নির্ভরযোগ্যতার কারণে এটি বৈশ্বিক সামরিক অভিযানে একটি নির্ভরযোগ্য 'ওয়ার্কহর্স' হিসেবে পরিচিত।
উচ্চ লিফট উইং ও দক্ষ ইঞ্জিন প্রযুক্তির ফলে সি-১৭ কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন মিত্রদেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
- এয়ারবাস এ৪০০এম এটলাস
দৈর্ঘ্য: ৪৫.১ মিটার
সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা: ৩৭,০০০ কেজি
ধরন: সামরিক
উৎপত্তি: ইউরোপীয় ইউনিয়ন (এয়ারবাস)

এয়ারবাস এ৪০০এম এটলাস হলো একাধিক ইউরোপীয় দেশের সম্মিলিত উদ্যোগে নির্মিত আধুনিক সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ।
এটি ভারী মালামাল বহন, অপরিকল্পিত রানওয়ে থেকে অপারেশন এবং এয়ারিয়াল রিফুয়েলিংয়ের মতো বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয়।
২০১০-এর দশকে চালু হওয়া এই বিমানটি উন্নত প্রযুক্তি ও ফ্লাই-বাই-ওয়্যার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সজ্জিত। এটি ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা লজিস্টিকস এবং মানবিক মিশনে ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করছে।