স্বজনপ্রীতির তকমা এড়াতে বিলিয়নিয়ার বাবার ছেলেকে করতে হয়েছে এমবিএ, অন্য চাকরি

সব বাবা-ই চান তার সন্তান তার স্থলাভিষিক্ত হোক। কিন্তু যদি সেই বাবা হন একজন রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, আর সম্পদের পরিমাণ হয় ৪০ বিলিয়ন ডলার, তবে উত্তরসূরির যাত্রাটা তো সোজাই হওয়ার কথা, তাই না?
কিন্তু জর্জ পেরেজ সে পথে হাঁটেননি।
'মিয়ামির কন্ডো কিং' নামে পরিচিত আর্জেন্টাইন-আমেরিকান ব্যবসায়ী জর্জ পেরেজ সম্প্রতি তার দুই ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন নিজের গড়া বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি রিলেটেড গ্রুপ -এর দায়িত্ব।
বড় ছেলে জন পল এখন সিইও, আর ছোট ছেলে নিক কনডো ইউনিটের প্রেসিডেন্ট। তবে এই দায়িত্ব তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পায়নি—পেয়েছে কঠিন প্রস্তুতি আর দীর্ঘ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে।
জর্জ বলেন, "আমি চেয়েছি সবাই বুঝুক, ওরা স্রেফ আমার ছেলে বলেই নয়—নিজেদের যোগ্যতায় নেতৃত্বে এসেছে।"
এই উত্তরসূরি তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল প্রায় দুই দশক আগে। জর্জ ছেলেদের স্পষ্ট করে দেন: কোম্পানির সিংহাসনে বসতে চাইলে—আগে পাঁচ বছর অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হবে,তারপর বিশ্বমানের এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করতে হবে,এরপর নিজের কোম্পানিতে নিচু পদ থেকে ধাপে ধাপে উঠতে হবে।
ছেলে জন পল প্রথমে কাজ শুরু করেন নিউ ইয়র্কের রিলেটেড কোম্পানিস-এ, যেখানে তিনি বিলাসবহুল প্রকল্পে কাজ করেছেন ১২-১৪ ঘণ্টার ক্লান্তিকর শিফটে। তারপর ফিরে এসে বাবার কোম্পানিতে শুরু করেন প্রজেক্ট সহকারী হিসেবে। এরপর ১৩ বছর সময় নিয়ে একে একে সব ধাপ পেরিয়ে ওঠেন সিইও পদে।
"আমি এমন এক পরিবেশে ছিলাম যেখানে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হতো—পুরোটাই ছিল টেকনিক্যাল ফাইন্যান্স আর ফাইন্যান্সিয়াল আন্ডাররাইটিংয়ের কাজ," বলেন জন , "ওই সময়টা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এতে আমি ব্যবসার অর্থনৈতিক দিকটা ভালোভাবে বুঝতে শিখি—যেটা এখানে এসে খুব কাজে লেগেছে।"
ছেলে হলেও 'চাকরি নিশ্চিত' নয়, অর্জন করতে হয়েছে পদ
২০১২ সালে অবশেষে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান 'রিলেটেড গ্রুপ'-এ নিজের জায়গা করে নেন জন পল। শুরু করেন রেন্টাল কাজ দিয়ে। সেখান থেকে ধাপে ধাপে কাজ শিখে ১৩ বছর সময় নিয়ে উঠে আসেন নেতৃত্বের পর্যায়ে।
কাজের ফাঁকেই ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কেলগ স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট থেকে অর্জন করেন এমবিএ ডিগ্রি।
কোভিড-১৯ মহামারির সময়, যখন সবাই ঘরে বসে কাজ করছিলেন, তখনই প্রতিষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যনির্বাহী দায়িত্ব নেন তিনি। আর ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করেন নেতৃত্বের আসনে।
জন পল বলেন, "অনেকেই ভাবে আমি তো সোজা চেয়ারে বসেছি। কিন্তু বাস্তবে আমাকে প্রতিটি ধাপে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে। সময় লেগেছে, তবে আমি জানতাম—এভাবেই সবার সম্মান অর্জন করা যায়।"
বাবা জর্জ যোগ করেন, "এটা ছিল খুব সচেতন পরিকল্পনা। আমি চেয়েছি বাইরের দৃষ্টিতে এটা যেন না লাগে, 'বাবা সরে গেছেন, এখন ছেলের সময়'। আমি দেখাতে চেয়েছি—ওরা প্রস্তুত, নতুন চিন্তা ও তরুণদের বাজার বোঝার দিক দিয়ে ওরা অনেক এগিয়ে।"
বিশ্বজুড়ে পারিবারিক ব্যবসায় উত্তরাধিকার নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। বহু সফল পরিবার সেখানে মুখোমুখি হয় দ্বন্দ্ব আর বিভক্তির। কিন্তু জর্জ সেটা হতে দেননি।
"অনেক পরিবারকে দেখেছি উত্তরাধিকার নিয়ে যারা শত্রুতে পরিণত হয়," বলেন জর্জ। "আমি চাইনি আমাদের মধ্যে তা হোক। হ্যাঁ, আমি জেদি, এটা সহজ ছিল না। কিন্তু তবুও পেরেছি।"
জর্জ স্বীকার করেন, তার ছেলেরা হয়তো এখনও বড় বাজার ধস বা গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়নি, কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই।
রিলেটেড গ্রুপ এখন পর্যন্ত ১২০,০০০-এর বেশি বাড়ি বানিয়েছে, ৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি বিক্রি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি মেক্সিকোতেও রয়েছে তাদের প্রকল্প।
জন পল, নিক আর জর্জ এখন তিনজন তিনটি ভিন্ন ভূমিকা পালন করছেন—তবে লক্ষ্য একটাই: প্রতিষ্ঠানকে আরও এগিয়ে নেওয়া।
"আমি এখনও আছি, ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে," বলেন জর্জ। "আর ওরা আছে নতুন চিন্তাধারা আর তরুণ প্রজন্মের চোখ নিয়ে। একসঙ্গে আমরা কোম্পানিকে আগের চেয়েও এগিয়ে নিতে পারব।"
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা