ইয়েমেনের তিনটি বন্দর ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা ইসরায়েলের

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সোমবার ভোরে জানিয়েছে, তারা ইয়েমেনের তিনটি বন্দর ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে হুথি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতির পর ইয়েমেনে এটিই প্রথম ইসরায়েলি হামলা। এ হামলার জবাবে হুথি বিদ্রোহীরাও ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আরও বলেছে, ইসরায়েলের ওপর হুথিদের উপর্যুপরি হামলার জবাবেই হোদাইদা, রাস ইসা ও সালিফ বন্দর এবং রাস কান্তিব বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই হামলা চালানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইরান-সমর্থিত হুথিরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে ইসরায়েল ও লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে আসছে, যা বিশ্ব বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
ইসরায়েলের দিকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের বেশিরভাগই হয় ভূপাতিত করা হয়েছে, নয়তো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। এর জবাবে ইসরায়েলও একাধিকবার পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আরও জানায়, তারা রাস ইসা বন্দরে থাকা 'গ্যালাক্সি লিডার' নামের একটি গাড়ি পরিবহনকারী জাহাজেও হামলা চালিয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের জের ধরে লোহিত সাগর করিডোরে হুথিরা যখন হামলা শুরু করে, তখনই তারা এই জাহাজটি জব্দ করেছিল।
বাহামার পতাকাবাহাবী 'গ্যালাক্সি লিডার' জাহাজের সঙ্গে একজন ইসরায়েলি ধনকুবের যুক্ত ছিলেন। জাহাজটি পরিচালনা করত জাপানি প্রতিষ্ঠান এনওয়াইকে লাইন।
ইসরায়েলের দাবি, হুথিরা জাহাজটিতে একটি রাডার ব্যবস্থা স্থাপন করেছে এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে অনুসরণ করার জন্য এটি ব্যবহার করছে।
এই হামলার পর হুথিদের সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা 'স্থানীয়ভাবে তৈরি বিপুলসংখ্যক ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে' ইসরায়েলি হামলা প্রতিহত করেছে।
এরপর হুথিরা ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে পাল্টা জবাব দেয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও সেটি ভূখণ্ডে আঘাত হেনেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
লোহিত সাগরের বন্দরনগরী হোদাইদার বাসিন্দারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ইসরায়েলি হামলায় প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিকল হয়ে পড়েছে। ফলে পুরো শহর অন্ধকারে ডুবে গেছে।
তবে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
হুথি-পরিচালিত আল-মাসিরা টেলিভিশন জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইয়েমেনের তিনটি বন্দরে লোকজনকে সরে যাওয়ার সতর্কতা জারি করার কিছুক্ষণ পরেই হোদাইদায় একাধিক হামলা চালায়।
রোববার লোহিত সাগরে লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী একটি জাহাজে হামলার পরই ইসরায়েল এই আক্রমণ চালাল। হামলায় জাহাজটিতে আগুন ধরে গিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করলে এর নাবিকরা সেটি থেকে নেমে যেতে বাধ্য হন।
তাৎক্ষণিকভাবে কেউ এই জাহাজে হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে নিরাপত্তা সংস্থা অ্যামব্রে বলছে, গ্রিক মালিকানাধীন 'ম্যাজিক সিজ' নামক এই বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজটির ধরণ হুথিদের সাধারণ লক্ষ্যবস্তুর সঙ্গেই মিলে যায়।
বাল্ক ক্যারিয়ার 'ম্যাজিক সিজ' উত্তরে, মিশরের সুয়েজ খালের দিকে যাচ্ছিল। হুথি-নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনের হোদাইদা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে জাহাজটির ওপর হামলা হয়।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে হুথিরা ১০০টিরও বেশি বাণিজ্যিক জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করেছে। এসব হামলায় দুটি জাহাজ ডুবে গেছে ও চারজন নাবিক নিহত হয়েছেন।
হুথিদের এসব অভিযানের কারণে লোহিত সাগর করিডর দিয়ে বাণিজ্যের প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। এ পথ দিয়ে সাধারণত বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য পরিবাহিত হয়। গত কয়েক সপ্তাহে লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকলেও কিছুটা বেড়েছে।
হুথিরা নিজেদের উদ্যোগেই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে হামলা বন্ধ রেখেছিল। তবে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করলে সেই যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটে। এরপর কয়েক সপ্তাহ পার হলেও হুথিরা কোনো জাহাজে হামলা চালায়নি। যদিও মাঝেমধ্যে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রেখেছে। রোববার গোষ্ঠীটি ইসরায়েলে একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার দাবি করে, যা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রতিহত করেছে বলে জানিয়েছে।
ইসরায়েল এই অঞ্চলে ইরানের অন্যান্য মিত্রশক্তি—লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে তেহরান-সমর্থিত হুথি ও ইরাকের ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এখনও সক্রিয় রয়েছে।
হুথি গোষ্ঠীদের পত্তন আব্দুল মালিক আল-হুথির হাতে। এই নেতার হাত ধরে সাদামাটা পার্বত্য যোদ্ধাদের দলকে আজ বিশ্বশক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আল-হুথির নেতৃত্বে দলটি এখন হাজার হাজার যোদ্ধার এক বিশাল সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে; সশস্ত্র ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অস্ত্র অর্জন করেছে। সৌদি আরব ও পশ্চিমা দেশগুলোর দাবি, এই অস্ত্র ইরান সরবরাহ করেছে। যদিও তেহরান বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।