গাজায় যুদ্ধাপরাধ: বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধের আহবান জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞের

গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতার আশঙ্কা তুলে ধরে, ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসা বন্ধে বিশ্বজুড়ে বহু বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের একজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ। খবর বিবিসির।
ইসরায়েলের এই আগ্রাসনকে 'ইকনোমিক জেনোসাইড' বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইতালির আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী ফ্রানচেস্কা আলবানিজ। তিনি আরও বলেন হামাসের কর্মকান্ড মূলত এই গণহত্যা চালানোর পরীক্ষাগার সৃষ্টি করে দিয়েছে, যেখানে কোনো জবাবদিহিতা বা নজরদারি নেই।
ইসরায়েল এই প্রতিবেদনকে 'ভিত্তিহীন' বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলেছে, এটি 'ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে জায়গা পাবে।'
ফ্রানচেস্কা আলবানিজ এর আগেও তার স্পষ্ট অবস্থানের জন্য পরিচিত। পূর্ববর্তী রিপোর্টে তিনি গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছিলেন। এবারও সেই দাবি পুনরায় তুলে বলেছেন, 'ইসরায়েল আধুনিক সময়ের অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যা চালাচ্ছে।'
প্রতিবেদনটিতে বেশ কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারা এই সংঘাতে লাভবান হচ্ছে এবং এ কারণে যুদ্ধাপরাধে পরোক্ষভাবে যুক্ত।
যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে অস্ত্র নির্মাতা লকহিড মার্টিন, যারা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আলফাবেট, আইবিএম, মাইক্রোসফট ও অ্যামাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নজরদারি ও লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যবহৃত প্রযুক্তি সরবরাহ করছে।
গৃহধ্বংস ও বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো সমতল করার কাজে ব্যবহৃত যানবাহন সরবরাহকারী হিসেবে ক্যাটারপিলার, হুন্দাই ও ভলভোর নামও এসেছে।
এছাড়া ব্যাংকিং খাতের দুটি প্রতিষ্ঠান, বিএনপি প্যারিবা ও বার্কলেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তারা ইসরায়েলি সরকারি বন্ডের অর্থায়নে ভূমিকা রেখেছে।
এ বিষয়ে বিবিসি এসব কোম্পানির মন্তব্য চেয়েছে। লকহিড মার্টিন জানিয়েছে, তাদের অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি সরকারে সরকারে হয় এবং সে বিষয়ে মন্তব্য করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার উপযুক্ত।
ভলভো জানিয়েছে, আলবানিজের সমালোচনার সঙ্গে তারা একমত নয়। 'আমাদের পণ্যের ব্যবহারে আমাদের নিয়ন্ত্রণ সীমিত, কারণ এগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বহু হাতে যায়',জানান তারা।
প্রতিবেদন বলছে, এসব কোম্পানির জন্য এই ব্যবসা লাভজনক এবং এভাবেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। আলবানিজ মনে করেন, এসব কোম্পানিকে এখনই ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করা উচিত।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি না করলেও এটি আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। আলবানিজ চাইছেন এই অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর আঘাত করে বহু কোম্পানি ও দেশকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সময়কার মতো ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে।
তখনো অনেক কোম্পানি বাণিজ্যে লাভ করলেও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিনিয়োগ তুলে নিতে হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থার পতনে সাহায্য করে।
এই প্রতিবেদনে বহুল পরিচিত কোম্পানিগুলোর নাম তুলে ধরে তিনি হয়তো বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের পণ্য বেছে নেওয়ার সময় চিন্তাভাবনা করার সুযোগ দিতে চাইছেন।
তবে সবচেয়ে গুরুতর যে অভিযোগটি তিনি তুলেছেন তা হলো—এই কোম্পানিগুলো 'গণহত্যায় সহযোগিতা' করছে। যদিও আইনগতভাবে কোনো কর্মকাণ্ডকে 'গণহত্যা' বলার সিদ্ধান্ত দিতে হয় আদালতকে, এবং এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একটি মামলা চলছে, যা দক্ষিণ আফ্রিকা দায়ের করেছে।
আন্তর্জাতিক আইনে 'সহযোগিতা' বলতে বোঝানো হয়—যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এমন কিছু করেছে যার ফলাফল পূর্বানুমানযোগ্য ছিল এবং তা গণহত্যাকে সহায়তা করেছে, যদিও সরাসরি গণহত্যার ইচ্ছা ছিল না।
আলবানিজ মনে করেন, যারা ইসরায়েলের যুদ্ধে কাজে লাগতে পারে এমন কিছু বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ তোলা যেতে পারে। ইউরোপের অনেক দেশকে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি চালিয়ে গেলে তারাও জটিলতায় পড়তে পারে।
ইসরায়েল বহুদিন ধরেই আলবানিজকে পক্ষপাতদুষ্ট এবং এমনকি ইহুদিবিদ্বেষী বলে অভিযোগ করে আসছে। এবারও তারা এই প্রতিবেদনকে 'অভিযোগভিত্তিহীন, মানহানিকর এবং দায়িত্বের চরম অপব্যবহার' হিসেবে বর্ণনা করেছে।
তবে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রদের সামনে যখন আলবানিজ প্রতিবেদন পেশ করেন, তখন বেশিরভাগই প্রশংসা ও সমর্থন জানিয়েছে। আফ্রিকান, এশীয় ও আরব দেশগুলো বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বানে সমর্থন জানায় এবং কেউ কেউ গণহত্যার কথা মেনে নেয়।
ইউরোপীয় দেশগুলোও গাজায় সাহায্য বন্ধের নিন্দা জানায় এবং ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানায় যেন তারা একজন দখলদার শক্তি হিসেবে ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করে।
তবে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে আগেই বেরিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আলবানিজের প্রচেষ্টা 'যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অর্থনীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ।'
আলবানিজের এই বক্তব্য আমেরিকার সরকার গুরুত্ব না দিলেও, তার রিপোর্টে নাম ওঠা বড় বড় মার্কিন কোম্পানিগুলো যখন বিভিন্ন দেশের নিন্দার মুখে পড়ছে, তখন তারা হয়তো ইসরায়েলের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে বাধ্য হবে।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা