মৃত্যুকূপ গাজায় সাংবাদিকতা: প্রতি মাসে গড়ে ১৩ সাংবাদিকের মৃত্যু, ২২ মাসে নিহত ২৭০

আল জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ (২৮) গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান ফটকের বাইরে সাংবাদিকদের জন্য স্থাপিত একটি মিডিয়া তাঁবুতে ইসরায়েলের ইচ্ছাকৃত হামলায় তার চার সহকর্মীর সঙ্গে নিহত হয়েছেন।
রোববার স্থানীয় সময় রাত প্রায় ১১টা ৩৫ মিনিটে একটি ইসরায়েলি ড্রোন ওই তাঁবুতে হামলা চালায় বলে জানান আল জাজিরার প্রতিবেদক হানি আল-শায়ের।
মোট সাতজন ওই হামলায় নিহত হন। নিহতদের মধ্যে আছেন আল জাজিরার প্রতিবেদক মোহাম্মদ কুরেইকেহ (৩৩) এবং ক্যামেরাপার্সন ইব্রাহিম জাহের (২৫), মোহাম্মদ নুফাল (২৯) ও মোয়ামেন আলিওয়া (২৩)।
আল জাজিরা সাংবাদিকদের ওপর ধারাবাহিক হামলা
এটি প্রথম ঘটনা নয়। গাজা যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরায়েল অন্তত পাঁচজন আল জাজিরা সাংবাদিককে হত্যা করেছে।
২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর গাজার খান ইউনিসে প্রতিবেদনের সময় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন আল জাজিরার ক্যামেরাপার্সন সামের আবুদাকা। একই হামলায় গাজার ব্যুরোপ্রধান ওয়েল দাহদুহ আহত হন। আবুদাকাকে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা হয়, কারণ ইসরায়েলি সেনারা উদ্ধারকর্মীদের পৌঁছাতে বাধা দেয়।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি খান ইউনিসে গাড়িতে ভ্রমণের সময় মিসাইল হামলায় নিহত হন ওয়েলের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও আল জাজিরা সাংবাদিক হামজা দাহদুহ।

২০২৪ সালের ৩১ জুলাই, শাতি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় সাংবাদিক ইসমাইল আল-ঘোল এবং তার ক্যামেরাপার্সন রামি আল-রিফি নিহত হন, যদিও তাদের গাড়িতে স্পষ্ট 'গণমাধ্যম' চিহ্ন ছিল এবং দু'জনই গণমাধ্যমের সদস্য হিসেবে পরিচয় বহনকারী 'প্রেস' লেখা ভেস্ট পরেছিলেন।
১৫ ডিসেম্বর মধ্য গাজার নুসেইরাত শিবিরে বিমান হামলায় নিহত হন আল জাজিরার আহমেদ আল-লুহ আর ২৪ মার্চ উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় নিহত হন সাংবাদিক হোসাম শাবাত (২৩)।
গাজা: সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ
গাজার যুদ্ধ সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘাত।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্টস অব ওয়ার প্রকল্পের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ এবং ৯/১১-পরবর্তী আফগানিস্তান যুদ্ধ—মোট নিহত সাংবাদিকদের সংখ্যার চেয়েও বেশি।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানিয়েছে, ২০২৪ ছিল সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর—বিশ্বজুড়ে ১২০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। চলতি বছরেই গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৫০ জনের বেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন।
সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করা যুদ্ধাপরাধ
আল জাজিরা তাদের সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হত্যাকে 'গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরেকটি সুস্পষ্ট ও পরিকল্পিত আঘাত' হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে। তাদের ভাষ্যে, আল-শরীফ ও সহকর্মীরা ছিলেন গাজার ভেতর থেকে খবর প্রচারের শেষ কণ্ঠস্বরগুলোর মধ্যে, যেখানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রবেশ ইসরায়েল নিষিদ্ধ করেছে।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি মিশন অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে আল-শরীফ ও কুরেইকেহকে হত্যা করেছে, যারা 'ইসরায়েলের গণহত্যা ও অনাহারের নথি তুলে ধরছিলেন'।

জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সাংবাদিকদের বিনা ভয়ে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ হত্যাকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ আখ্যা দিয়ে আল-শরীফকে 'সাহসী ও অসাধারণ' সাংবাদিক হিসেবে উল্লেখ করেছে। ২০২৪ সালে তিনি মানবাধিকার রক্ষক পুরস্কার পান।
প্রতি মাসে গড়ে ১৩ সাংবাদিক নিহত
মনিটরিং ওয়েবসাইট শিরিন.পিএস-এর হিসাবে, ২২ মাসের যুদ্ধে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ২৭০ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন—অর্থাৎ মাসে গড়ে প্রায় ১৩ জন। এই ওয়েবসাইটটির নামকরণ করা হয়েছে আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর নামে, যাকে ২০২২ সালে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল।
এই পরিসংখ্যানকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে এই বাস্তবতা যে, গাজা যখন মাঠ পর্যায়ের কণ্ঠস্বর হারাচ্ছে, ঠিক তখনই ইসরায়েল অবরুদ্ধ এ ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে সাংবাদিকদের হত্যা ও আটক গাজায় এমন এক তথ্যশূন্যতা তৈরি করেছে, যা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ আড়াল করে দিচ্ছে।
এ বছরের জুনে আরএসএফ, সিপিজে ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যৌথ বিবৃতিতে জানায়, গাজায় স্থানীয় সাংবাদিকরা যারা বহির্বিশ্বের জন্য খবর সরবরাহ করছিলেন, তারা ক্রমাগত জীবন-হুমকির মুখে রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। অ্যামনেস্টি এক বিবৃতিতে বলেছে, 'ইসরায়েল কেবল সাংবাদিকদের হত্যা করছে না, বরং গণহত্যার নথিভুক্তি ঠেকাতে সাংবাদিকতাকেই আক্রমণ করছে।'
ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ চলাকালে নিহত সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাম নিচে দেওয়া হলো:
