কেন বছরে তিনবার জন্মদিন পালন করেন আদানি?

গত সপ্তাহেই নিজের ৬৪তম জন্মদিন পালন করলেন ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানি। এ পর্যন্ত তো অনেকেই জানেন। কিন্তু জানেন কি, প্রতি বছর একবার নয়, তিনবার জন্মদিন উদযাপন করেন তিনি?
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন—তিনবার। একটি অবশ্য তার আসল জন্মদিন। কিন্তু বাকি দুটো দিন? সেগুলোও তার কাছে জন্মদিনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওই দুই দিনে তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে শেষমেশ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন।
গৌতম আদানির জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ভাগ্য যদি একটুও এদিক-ওদিক হতো, হয়তো আজ তার নামটিও শোনা যেত না। সেই অভিজ্ঞতাগুলো শুধু তার জীবনই বদলে দেয়নি—পাল্টে দিয়েছে তার চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধ।
এই তিনটি দিন—তার কাছে তিনবার নতুন করে জন্ম নেওয়ার মতো।
প্রথম জন্মদিন: যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলেন গৌতম আদানি
১৯৬২ সালের ২৪ জুন, আহমেদাবাদের এক সাধারণ পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্ম নেন গৌতম আদানি। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। তার বাবা ছোটখাট একটি কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। সাদামাটা সংসার হলেও সেখানে ছিল ভালোবাসা, পরিশ্রম এবং একে অপরের পাশে থাকার মানসিকতা। ছোটবেলা থেকেই গৌতম শিখেছিলেন পরিশ্রমের মূল্য, আদর্শে স্থির থাকার শিক্ষা এবং নিজের চেষ্টা দিয়েই ভাগ্য গড়ার বিশ্বাস।
তার পড়াশোনা শুরু হয় শেঠ চিমনলাল নাগিন্দাস বিদ্যালয়ে। এরপর উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়ালেও, প্রচলিত ক্লাসরুম যেন একপ্রকার বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার বিস্তৃত ভাবনার জন্য। ১৬ বছর বয়সেই তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন। মনভরা উচ্ছ্বাস আর আগ্রহ নিয়ে তিনি পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে—স্বপ্নের শহরে। সঙ্গে ছিল কেবল কিছু টাকাপয়সা, কিন্তু মনের ভিতরে ছিল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
মুম্বাইয়ে তার কর্মজীবনের শুরু হয় একটি হীরা বাছাইকারী হিসেবে। এই পেশা তাকে শিখিয়েছে নিখুঁত পর্যবেক্ষণ, ধৈর্য আর ক্ষুদ্র মুনাফায় বৃহৎ সাফল্য অর্জনের কৌশল। বুঝিয়ে দিয়েছে গতি আর মনোযোগের গুরুত্ব, এবং হিসাবের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তিনি গড়ে তোলেন নিজের ডায়মন্ড ব্রোকারেজ ব্যবসা, আর এখান থেকেই মেলে জীবনের প্রথম বড় চুক্তির সাফল্য।
তবে ভাগ্য যেন তাকে হীরার জগৎ থেকে সরিয়েই আনতে চেয়েছিল।
১৯৮১ সালে তিনি ফিরে আসেন আহমেদাবাদে, বড় ভাইয়ের প্লাস্টিকের কারখানায় কাজের টানে। দেখতে সাধারণ মনে হলেও, এই ছোট উদ্যোগটিই হয়ে ওঠে তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। প্লাস্টিকের মূল উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) আমদানির মধ্য দিয়ে তিনি প্রবেশ করেন বৈশ্বিক বাণিজ্যের দুনিয়ায়।
এর ঠিক সাত বছর পর, ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আদানি এক্সপোর্টস—যা পরবর্তীতে রূপ নেয় সুবিশাল আদানি গ্রুপে। শুরুতে এটি কৃষিপণ্য ও বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত জিনিসের বাণিজ্যে যুক্ত ছিল।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ভারতের অর্থনীতির উন্মুক্তকরণ গৌতম আদানির স্বপ্নে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এই পরিবর্তনে তার প্রতিভা আর বিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় একধরনের কঠিন মানসিক দৃঢ়তা—যা যেকোনো প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার শক্তি এনে দেয় তাকে।
দ্বিতীয় জন্মদিন: অপহরণ থেকে বেঁচে ফেরার দিন
আদানির 'দ্বিতীয় জন্মদিন' ১ জানুয়ারি, ১৯৯৮—যে দিনটি তার জীবন উদযাপনের চেয়ে বেশি টিকে থাকার তাৎপর্য বহন করে। সেদিন আহমেদাবাদের কারনাবতী ক্লাব থেকে সহকর্মী শান্তিলাল প্যাটেলের সঙ্গে বের হওয়ার সময় তাদের গাড়ি ঘিরে ধরে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত। তাদের অপহরণ করা হয়। সেই রাতটা আদানির জন্য ছিল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো। একটি অনিশ্চিত খেলার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, যেখানে জীবন-মৃত্যুর হিসেব ঝুলে ছিল সূক্ষ্ম এক সুতোর উপর।
যদিও সেই রাতের সব তথ্য এখনও আড়ালে, শোনা যায়, গৌতম আদানি ঠাণ্ডা মাথায় কৌশল অবলম্বন করে অপহরণকারীদের সঙ্গে তাস খেলতে (সম্ভবত রামি) শুরু করেন।
তবে এই খেলাটা নিছক সময় কাটানোর জন্য ছিল না। ওই ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও নিজেকে সংবরণ করে পরিস্থিতি বুঝে নেওয়ার এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার যে অসাধারণ ক্ষমতা তিনি দেখিয়েছিলেন, তা তাকে শুধু ওই রাতেই নয়, পরবর্তী বহু সংকটেও জয়ী হতে সাহায্য করেছে।
লোকমুখে বলা হয়, তিনি শারীরিকভাবে লড়েননি, লড়েছেন মানসিকভাবে। এই ক্ষমতাই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছে তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি—ব্যক্তিগত বিপর্যয় হোক কিংবা জটিল ব্যবসায়িক পরিস্থিতি, প্রতিবারই তিনি যেন রণকৌশলের একজন দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে এসেছেন। সম্ভাব্য পরাজয়কে বদলে দিয়েছেন সাহসিকতা ও স্থিতধী মনোভাবের এক অনন্য কাহিনিতে।
তৃতীয় জন্মদিন: ২৬/১১ সন্ত্রাসী হামলা থেকে বেঁচে ফেরা
১১ বছর পর আবারও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন গৌতম আদানি। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ে ঘটে ইতিহাসের এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। ওই রাতে তিনি মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলের বিখ্যাত মাসালা ক্র্যাফট রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন দুবাই পোর্টের সিইও মোহাম্মদ শরাফ।
খাবার শেষে বিল মিটিয়ে তারা হোটেল থেকে বেরোবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কিছুক্ষণ আরও আড্ডা দিয়ে কফি খাওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁদের জীবন বাঁচায়। যদি তখনই তারা উঠে লবিতে যেতেন, গুলির মুখোমুখি হতেছিলেন সেখানেই।
হোটেলে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ—আদানি দেখেন সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে। নিজের নিরাপত্তা থেকে অনেক এগিয়ে গিয়ে তিনি অন্যদের বাঁচানোর চিন্তা করেন। চারপাশে হাহাকার সত্ত্বেও ছিলেন ঠাণ্ডা মাথায়।
বলা হয়, আতঙ্কিত সহযাত্রীদের মন শান্ত করতে তিনি হালকা হাসি ছড়িয়ে দেন, ধৈর্যের আহ্বান জানান। নারীদের আগে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর এবং বৃদ্ধদের সহায়তার বিষয়েও তিনি বিশেষভাবে নজর দেন। নিজে আশ্রয় নেওয়ার আগে নিশ্চিত হন সবাই নিরাপদ আছে কি না।
গুলির শব্দ বেড়ে গেলে, তিনি চারজনসহ একটি ছোট বাথরুমের কিউবিকলে গাদাগাদি করে আশ্রয় নেন। নিশ্বাস আটকে, শরীরের প্রতিটি পেশি থম ধরে অপেক্ষা করছিলেন—জানতেন না বাঁচবেন কি না।
গুলির মাঝে এক ফাঁকে ফোন করেন ক্যাপ্টেন মেহতাকে। তখনই জানতে পারেন, পুরো রেস্তোরেন্ট আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
পরে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, 'আপনি কি ভয় পেয়েছিলেন?' আদানির উত্তর ছিল বাস্তববাদী। 'হ্যাঁ, ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু ভেঙে পড়িনি। যদি আমার সময় হতো, তবে নিয়তি আমাকে নিয়ে যেত,' বলেন তিনি। সেই দুঃসময়ে তিনি অন্যদের সান্ত্বনা দিতে দেখিয়েছিলেন।
গৌতম আদানির এই তিন 'জন্মদিন' কেবল একজন সফল ব্যবসায়ীর গল্প নয়—এটি এক অসম সাহসিকতা এবং অদম্য মানসিকতার জয়গাথা।
এই ঘটনাগুলো বুঝিয়ে দেয়, কিভাবে তিনি প্রতিটি বিপদকে কখনও পরাজয় হিসেবে দেখেননি, বরং প্রত্যেকটিকে গ্রহণ করেছেন শিক্ষা হিসেবে। অপহরণের সময় অপহরণকারীদের সঙ্গে তাস খেলে সময় কাটানো হোক বা আগুনের মাঝেও অন্যদের সান্ত্বনা দেওয়া—প্রতিটি মুহূর্তে তিনি নিজের অসাধারণ সংযম ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন।
প্রতিবারই উঠে দাঁড়িয়েছেন আগের চেয়ে আরও দৃঢ় হয়ে, নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে।