বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্র কোথায় আছে, কারা সেগুলোর মালিক?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে "ধ্বংস করে দিয়েছেন"। তবে, এসব হামলার প্রকৃত প্রভাব এবং এতে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা কতটা পিছিয়ে গেল, তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসহ বিশ্বের ৯টি দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) এ মাসেই সতর্ক করেছে, একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার হাতে রয়েছে বিশ্বের ৮৭ শতাংশ পারমাণবিক অস্ত্র
২০২৫ সালের শুরুর দিকে, অনুমান করা হয় ৯টি দেশের হাতে মোট ১২ হাজার ২৪১টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দখলে রয়েছে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র, যা প্রায় ৮৭ শতাংশ। এ তথ্য দিয়েছে সিপ্রি ও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে স্বচ্ছতা বাড়াতে কাজ করা অলাভজনক সংস্থা ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস (এফএএস)। বাকি ১৩ শতাংশ অস্ত্র রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরায়েলের হাতে।
প্রায় ৯ হাজার ৬১৪টি ওয়ারহেড বিভিন্ন দেশের সামরিক অস্ত্রাগারে রয়েছে, যেগুলো ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান, জাহাজ ও সাবমেরিনে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯১২টি "মোতায়েনকৃত কৌশলগত ও অ-কৌশলগত ওয়ারহেড" হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ এগুলো আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, ভারী বোমারু ঘাঁটি বা স্বল্প-পাল্লার অস্ত্রবাহী ঘাঁটিতে সক্রিয় অবস্থায় আছে।
পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ গোপন রাখে বেশিরভাগ দেশ
দেশগুলো সাধারণত তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের সঠিক তথ্য গোপন রাখে। তাই গবেষক ও পারমাণবিক নিরীক্ষকরা অনুমানের ভিত্তিতেই হিসাব প্রকাশ করেন। এখন পর্যন্ত কেবল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছে সিপ্রি। এফএএস বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পারমাণবিক স্বচ্ছতা কমে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে ইসরায়েলের নাম শোনা গেলেও তারা কখনো এ বিষয় নিশ্চিত বা অস্বীকার করে না। তবে ধারণা করা হয়, ইসরায়েলের কাছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
এফএএস জানিয়েছে, তারা তাদের অনুমান তৈরি করেছে "সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত তথ্য, ইতিহাসভিত্তিক রেকর্ডের বিশ্লেষণ এবং কিছু ভুল করে প্রকাশ হওয়া তথ্যের" ভিত্তিতে, এবং এগুলো অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অনুমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
কোন কোন দেশে রাখা আছে পারমাণবিক অস্ত্র?
যদিও কেবল ৯টি দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, কিন্তু বিশ্বের ছয়টি দেশে অন্য দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রাখা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পাঁচটি দেশে এবং রাশিয়ার জন্য একটি দেশে। এ তথ্য জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ন্যাটো জোটের একটি "পারমাণবিক শেয়ারিং" চুক্তি আছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের কিছু নির্দিষ্ট স্থানে তার পারমাণবিক অস্ত্র সংরক্ষণ করে। ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা এসব অস্ত্রের অবস্থান নিয়ে মুখ বন্ধ রাখলেও, সাধারণভাবে জানা যায় ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, তুরস্ক ও বেলজিয়ামে এসব অস্ত্র সংরক্ষিত আছে।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রচারণা সংস্থা (আইক্যান)-এর তথ্য অনুযায়ী, এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১০০টি পারমাণবিক অস্ত্র রাখা হয়েছে। তবে গ্রিস আর পারমাণবিক অস্ত্র সংরক্ষণ করে না, কিন্তু জরুরি পরিস্থিতির জন্য একটি রিজার্ভ স্কোয়াড্রন এখনও রাখে বলে জানিয়েছে এফএএস।
এসব অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। তবে, এসব মিত্র দেশের মাটিতে অস্ত্র রাখা মানে হচ্ছে, "যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা," বলেছেন যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের নিউক্লিয়ার পলিসি বিভাগের পরিচালক লুকাস কুলেসা। তিনি বলেন, "এটা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের ময়দানে আছে।"
অন্য দেশে পারমাণবিক অস্ত্র রাখা একটি নিরস্ত্রীকরণ কৌশল হিসেবেও কাজ করে, বলেন কুলেসা। "যদি কোনো দেশের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, তাহলে সেই দেশ নিজস্ব অস্ত্র তৈরির কথা ভাববে না।"
২০২৩ সালের মার্চে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়েছিলেন, তারা প্রতিবেশী বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র সংরক্ষণ করবে। তিন মাস পর, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট ও পুতিনের ঘনিষ্ঠ সমর্থক আলেকজান্দার লুকাশেঙ্কো দাবি করেন, তাদের দেশে রাশিয়ান পারমাণবিক অস্ত্র আসা শুরু হয়েছে।
তবে ২০২৫ সালের সিপ্রি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া ও বেলারুশ দুইদেশই পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের দাবি করলেও, এর পক্ষে কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আইক্যান জানিয়েছে, বেলারুশে কত অস্ত্র রাখা হয়েছে তা "অজানা"।
পারমাণবিক অস্ত্রের ভবিষ্যৎ কী?
স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা একসময় ৭০ হাজারে পৌঁছেছিল। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এই সংখ্যা কমার প্রবণতা দেখা গেলেও, বর্তমানে বৈশ্বিক সংঘাত ও নিরাপত্তা সংকট বাড়তে থাকায় সেই সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিপ্রির ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে সংস্থাটির পরিচালক ড্যান স্মিথ লেখেন, "চিহ্নগুলো বলছে যে একটি নতুন, বৈচিত্র্যময় এবং আরো বিপজ্জনক পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে চলেছে।"
কুলেসা বলেন, এখন পারমাণবিক অস্ত্রধারী ৯টি দেশের মধ্যে বেশিরভাগই এসব অস্ত্রকে তাদের নিরাপত্তা কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। তাই তিনি মনে করেন, অস্ত্রের সংখ্যা একই থাকবে বা বাড়তেও পারে।
তবে তিনি এটাও যোগ করেন, ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার ব্যাপারটি সবার জানা থাকলেও তা অন্য দেশ বা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে হামলা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আবার রাশিয়ার পারমাণবিক হুমকির পরও পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে সাহায্য পাঠিয়েছে। এর মানে, "পারমাণবিক প্রতিরোধ" নামে পরিচিত সেই প্রচলিত ধারণা—যেখানে মনে করা হয় পারমাণবিক হামলার ভয় কিছুটা স্থিতিশীলতা আনে—তা বাস্তবে কাজ করছে না।
"ধারণাটা ছিল, প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়ালে শত্রু পক্ষ আক্রমণ করার সাহস করবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এটি উল্টো প্রভাব ফেলছে, শত্রু পক্ষ মনে করছে, তাদের নিজের অস্ত্রের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে," বলেন কুলেসা। "ফলে, এক ধরনের চক্র তৈরি হয়েছে যেখানে এক পক্ষ প্রতিরক্ষা বাড়ালে, অন্য পক্ষ পারমাণবিক অস্ত্র বাড়িয়ে দেয়।"
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা