উত্তর কোরিয়ায় পর্যটক টানতে সাগরতীরে বিশাল রিসোর্ট খুললেন কিম জং উন

পৃথিবীর বিচ্ছিন্নতম দেশ উত্তর কোরিয়া। বহির্বিশ্বের সাথে নিজেদের পুরোপুরি সরিয়ে রেখেছে এই কমিউনিস্ট দেশটি, যোগাযোগও অতি সামান্যই। তবে পর্যটন খাতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে দেশটির নেতা কিম জং উন সমুদ্রতীরে একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম কেসিএনএ'র বরাতে এ খবর জানিয়েছে বিবিসি।
দেশটির পূর্ব উপকূলের ওনসানে নির্মিত 'ওনসান কালমা' রিসোর্টটি আগামী ১ জুলাই থেকে দেশীয় পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ছয় বছর আগে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় এতদিন তা পিছিয়ে যায়। তবে বিদেশিদের জন্য কবে থেকে এটি উন্মুক্ত হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
রিসোর্টটি যেখানেই নির্মিত হয়েছে, সেই ওনসান শহরেই বিলাসবহুল জীবনে বেড়ে উঠেছেন কিম। এখানেই উত্তর কোরিয়ার বহু অভিজাতের ব্যক্তিগত ভিলা রয়েছে। শহরটি এক সময় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হলেও এখন কিম এটি পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরের চেষ্টা করছেন।
কেসিএনএ-এর দাবি, সমুদ্রের ধারে প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি রিসোর্টটিতে একসঙ্গে ২০ হাজার পর্যটক থাকতে পারবেন। সেখানে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল ও ওয়াটার পার্ক রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। তবে এসব তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখযোগ্যভাবে, পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা উত্তর কোরিয়া বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। দেশটির অধিকাংশ সম্পদ ব্যয় হয় সামরিক বাহিনী, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্থাপত্য নির্মাণে—যেগুলো মূলত রাজধানী পিয়ংইয়ং কেন্দ্রীক এবং কিম পরিবারের ব্যক্তিপূজাকে তুলে ধরার অংশ।
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, পর্যটন খুলে দিয়ে সহজ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ খুঁজছে পিয়ংইয়ং। দেশটিতে বিদেশি পর্যটক ঢুকতে পারলেও বেশিরভাগই আসেন চীন ও রাশিয়া থেকে—দুই দেশের সঙ্গেই উত্তর কোরিয়ার পুরোনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
'ইয়াং পায়োনিয়ার ট্যুরস'-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা রোয়ান বিয়ার্ড বিবিসিকে বলেন, 'আমি ভেবেছিলাম, এটি হয়তো আন্তর্জাতিক পর্যটনের জন্য একটি বড় ধরনের পুনরারম্ভের ইঙ্গিত, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা মনে হচ্ছে না।'
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের শুরুতে উত্তর কোরিয়া সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০২৩ সালের মাঝামাঝি এসে কিছুটা শিথিলতা আনা হলেও, প্রথমে শুধু রুশ পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া থেকে পর্যটকরা চীনের মাধ্যমে সীমান্ত পার হলেও কয়েক সপ্তাহের মাথায় আবার তা বন্ধ করে দেওয়া হয়, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই।
তবে কিছু ট্যুর অপারেটর মনে করেন, পশ্চিমা পর্যটকদের কাছে ওনসান তেমন আকর্ষণীয় হবে না। রোয়ান বিয়ার্ড বলেন, 'পিয়ংইয়ং, ডিমিলিটারাইজড জোন [বেসামরিক এলাকা], এবং কমিউনিস্ট স্থাপত্যভিত্তিক স্থানগুলোই বিদেশিদের কাছে মূল আকর্ষণ থাকবে।'
অন্যদিকে, 'উরি ট্যুরস'-এর পরিচালক এলিয়ট ডেভিস বলছেন, 'অপরিচিত ও অনন্য গন্তব্যে ঘুরতে আগ্রহী পর্যটকদের কাছে উত্তর কোরিয়া একটি নান্দনিক কৌতূহলের জায়গা। একটি সাধারণ সমুদ্রসৈকত রিসোর্ট, যা উত্তর কোরিয়ার সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে—তা এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা।'
কেসিএনএ রিসোর্টটি উদ্বোধনের ঘটনাকে 'জাতীয় জীবনে এক শুভ মুহূর্ত' এবং 'পর্যটনের এক নতুন যুগের সূচনা' হিসেবে উল্লেখ করেছে।
প্রথমে ২০১৯ সালের অক্টোবরে এটি উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু নির্মাণধাপে নানা সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ২৪ জুন একটি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে কিম রিসোর্টটির উদ্বোধন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন মেয়ে কিম জু এ এবং স্ত্রী রি সোল জু—যিনি চলতি বছর নতুন বছরের দিন অনুষ্ঠানের পর এই প্রথম জনসমক্ষে এলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মাতসেগোরা ও রুশ দূতাবাসের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, রিসোর্টটি শুরুতে রুশ পর্যটকদের জন্যই চালু করা হবে। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার যেসব অঞ্চলে বিদেশিদের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে, সেখানে কেবল রুশ নাগরিকরাই যেতে পারছেন।
এই রিসোর্ট উদ্বোধনের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যকার সহযোগিতা আরও ঘনিষ্ঠ হলো। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে দুই দেশের সম্পর্ক এখন নতুন মাত্রা পাচ্ছে।
সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পক্ষে সেনা পাঠিয়েছে। বৃহস্পতিবার দুই দেশের মধ্যে পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর পিয়ংইয়ং ও মস্কোর মধ্যে সরাসরি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলও আবার চালু হয়েছে।