যুদ্ধ শেষের ঘোষণা দিলেন ট্রাম্প; যেভাবে ১৪ বোমায় বদলে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্য

তিনি এলেন, বোমা ফেললেন, যুদ্ধ থামালেন—অন্তত ডোনাল্ড ট্রাম্প চান বিশ্ব এমনটাই ভাবুক। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেলথ বোমারু বিমান ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার গভীরে হামলা চালানোর দুই দিন পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন—ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে 'সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত' যুদ্ধবিরতি হয়েছে। ট্রুথ সোশাল প্ল্যাটফর্মে তিনি লেখেন, 'আমি ইসরায়েল ও ইরান—দুই দেশকেই অভিনন্দন জানাই। ১২ দিনের এই যুদ্ধ শেষ করতে তারা যে ধৈর্য, সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দেখিয়েছে, তা প্রশংসনীয়।'
যুদ্ধবিরতির খবরে শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, জ্বালানির দাম পড়েছে। যদিও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। তবে ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলে তারাও থেমে যাবে। তিনি বলেন, 'ইসরায়েলের আগ্রাসনের জবাবে আমাদের শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক অভিযান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলেছে।'
সংবাদে বলা হয়, ট্রাম্প প্রথমে ইসরায়েলের সম্মতি নেন, এরপর কাতারের মাধ্যমে প্রস্তাবটি ইরানের কাছে পাঠান। ট্রাম্প জানান, প্রথমে ইরান হামলা বন্ধ করবে, ১২ ঘণ্টা পর থামবে ইসরায়েল। তিনি বলেন, 'উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক আচরণ করবে।' এনবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই যুদ্ধবিরতি 'চিরকাল' স্থায়ী হবে।
ইসরায়েল গত ১৩ জুন আকস্মিকভাবে ইরানে হামলা চালায়। ওই হামলায় তারা ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে, কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও জেনারেলকে হত্যা করে এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।
এরপর ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র চালায় 'অপারেশন মিডনাইট হ্যামার'। মিসৌরি থেকে উড়ে আসা বি-২ বোমারু বিমান ৩৭ ঘণ্টার মিশনে ইরানের নাতানজ ও বিশেষভাবে সুরক্ষিত ফোরদো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে ১৪টি জিবিইউ-৫৭ 'ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর' (এমওপি) বোমা ফেলে। এর পাশাপাশি ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতেও সাবমেরিন থেকে ছোড়া হয় প্রায় ৩০টি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
পরদিন ইরান প্রতীকী পাল্টা হামলা চালায়। কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটির দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি এমওপি বোমার জবাবে ছোড়ে ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র। ট্রাম্প এক পোস্টে জানান, 'এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে ১৩টিই প্রতিহত করা হয় এবং ইরানের আগাম সতর্কবার্তার কারণে কেউ আহত হননি।' ঘটনার দুই ঘণ্টা পরই তিনি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন।
ফক্স নিউজ স্টুডিওতে ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, 'আমেরিকার অভিযানে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। আমরা নিশ্চিত, তারা (ইরান) পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে না।' তিনি দাবি করেন, এসব হামলায় ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ধ্বংস হয়ে থাকতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন তিনটি বড় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: যুদ্ধবিরতি কি টিকে থাকবে? ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে নতুন কোনো কূটনৈতিক চুক্তি হবে কি? আর যুদ্ধের পর অঞ্চলটি কি আগের চেয়ে স্থিতিশীল হবে?
যুদ্ধবিরতির দিকটি আগে দেখা যাক। ইসরায়েল বা ইরান কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়নি। তবে উভয়েরই যুদ্ধ থামানোর যুক্তিসংগত কারণ আছে।
ইরানের ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠী বহুদিন ধরে আমেরিকাবিরোধী স্লোগান দিয়ে এলেও সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায়নি। বরং তারা আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন সরকার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, সেনাবাহিনী কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে, আর মিত্র গোষ্ঠীগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্ভবত ট্রাম্পের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবেন না। তিনি ট্রাম্পের 'ঐতিহাসিক সামরিক হস্তক্ষেপ'-এর প্রশংসা করেছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে, তারা প্রায় সব লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করেছে। কেউ কেউ বলছেন, ইসরায়েল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই 'জয়' দাবি করে হামলা থামিয়ে দিতে পারে।
নেতানিয়াহুর কাছে এই বিজয় তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হতে পারে। অন্যদিকে, ট্রাম্প চান না যুদ্ধ দীর্ঘ হোক। তিনি আমেরিকানদের আশ্বস্ত করেছেন, দেশকে আর কোনো 'অন্তহীন আয়াতুল্লাহ খামেনি এখন মনে করতে পারেন, টিকে থাকার জন্য পারমাণবিক অস্ত্রই তাদের একমাত্র ভরসা।
যদিও ইরানের অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে, তবুও তারা গোপনে আবার কর্মসূচি শুরু করতে পারে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, তাদের কাছে নেই ৪০০ কেজি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের (৬০%) সঠিক অবস্থানসংক্রান্ত তথ্য। যদি ইরান সেন্ট্রিফিউজ রেখে দেয়, তবে তারা দ্রুতই ৯০% মাত্রার ইউরেনিয়াম তৈরি করতে সক্ষম হবে—যা দিয়ে প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব।
২০১৫ সালে ওবামার আমলে হওয়া পরমাণু চুক্তির লক্ষ্য ছিল—ইরান যেন অন্তত এক বছর সময় না পাওয়া পর্যন্ত অস্ত্র তৈরির উপযোগী উপাদান তৈরি করতে না পারে। ট্রাম্প প্রথম মেয়াদেই চুক্তিটি বাতিল করেন।
সম্প্রতি ইরানকে 'শূন্য সমৃদ্ধি' নীতির আওতায় আনতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। তার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ একটি প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে বলা হয়েছে—ইরান চাইলে দেশের বাইরে একটি আঞ্চলিক জোটের অংশ হিসেবে সীমিতভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে। তবে প্রস্তাবটি আলোচনার টেবিলে আছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন থেকেই যায়—তেহরানে 'বিপ্লবী মোল্লারা' ক্ষমতায় থাকলে কি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আসবে?
ইসরায়েল যদি গোপনে কোনো পারমাণবিক কর্মসূচির অস্তিত্ব খুঁজে পায়, তাহলে তারা আবার হামলা চালাতে পারে—চাই আমেরিকার সহায়তা থাক, না থাক। তারা চাইবে ইরানের প্রচলিত অস্ত্র ও মিত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে। কারণ গত এক বছর ধরে তারা লড়েছে ইরানি প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে এবং ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়েছে ইরান, লেবানন ও ইয়েমেন থেকে।
ইসরায়েল ও আমেরিকার কিছু মহল মনে করে, আয়াতুল্লাহ খামেনির পতন ছাড়া এই অঞ্চলে প্রকৃত শান্তি সম্ভব নয়। ২৩ জুন সেই লক্ষ্যে ইসরায়েল হামলা চালায় তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগার ও বাসিজ মিলিশিয়া সদর দপ্তরে।
ইরানিরা যদিও ইসরায়েলের ডাকে সাড়া দেয়নি, কারণ যুদ্ধ চলাকালে জনগণের বিদ্রোহ আশা করাই ছিল অবাস্তব। তবে যুদ্ধ থেমে গেলে এবং মানুষ যদি আয়াতুল্লাহদের ভুলের মূল্য গুনতে শুরু করে, তখন সেখানে গণবিক্ষোভ দেখা দিতে পারে।
এর আগ পর্যন্ত ইসরায়েল ও তাদের আরব মিত্ররা চায়, যুক্তরাষ্ট্র যেন মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকে।
'অপারেশন মিডনাইট হ্যামার'-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আবারও দেখিয়েছে, তারা এখনো এই অঞ্চলে অপরিহার্য শক্তি। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকেই চায়, যুক্তরাষ্ট্র যেন বিশ্ব পুলিশের ভূমিকা ছেড়ে প্রশান্ত মহাসাগরে মনোযোগ দেয়—চীনকে ঠেকাতে।
ভ্যান্স বলেন, ইরান কী ধরনের শাসনব্যবস্থা রাখবে, সেটি ইরানিদের ব্যাপার। তবে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'ভবিষ্যতে যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মরিয়া চেষ্টা করে, তাহলে তাদের এক অত্যন্ত শক্তিশালী মার্কিন সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতে হবে।'
নাটকীয় হামলার পর নাটকীয় যুদ্ধবিরতি—এখনও তা স্থায়ী শান্তির পথ নয়।