মার্কিন হামলার শিকার ইরানের ৩ পারমাণবিক স্থাপনা কোথায়, কী কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হয়?

মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা—নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফোরদোতে হামলা চালিয়েছে আজ (২২ জুন)।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমান অংশ নিয়েছিল।
ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে লেখেন, 'প্রধান স্থাপনা ফোরদোতে পূর্ণমাত্রার বোমা ফেলা হয়েছে। ফোরদো এখন ধ্বংস।'
নিউইয়র্ক টাইমসকেও একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ হামলায় ছয়টি বি-২ বোমারু বিমান অংশ নেয়। বিমানগুলো থেকে মাটির গভীরে অবস্থিত ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনার ওপর এক ডজন ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেলা হয়েছে।
নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় ৩০টি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র (টিএলএএম) ছোড়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, একটি বি-২ বিমান থেকে নাতাঞ্জেও দুটি বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেলা হয়েছে।
শনিবারের এই হামলায় মার্কিন বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর নামের ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের এই বাঙ্কার বাস্টার বোমা ব্যবহার করল।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো দেশটির অনেক জায়গায় ছড়িয়ে আছে। ইসরায়েল বহু বছর ধরে এসব স্থাপনায় হামলার হুমকি দিলেও, নিরাপত্তার জন্য কেবল কিছু স্থাপনাই মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ইরান ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটি গোপন ও সমন্বিত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালু রেখেছিল, যা পরে বন্ধ করা হয়। তবে ইরান বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ইরানের দাবি, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধুই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে।
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে ইরান পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখার চুক্তি করে। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই ইরান সেই শর্ত লঙ্ঘন করতে শুরু করে।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি ভাঙার পর থেকে ইরান দ্রুত তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি সম্প্রসারণ করেছে। এর ফলে 'ব্রেকআউট টাইম' অর্থাৎ ওয়েপেন-গ্রেড ইউরেনিয়াম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সময় এক বছরের বদলে এখন কয়েক দিন কিংবা এক সপ্তাহের মতো কমে এসেছে।
তবে শুধু ইউরেনিয়াম থাকার মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব নয়; এর জন্য আরও জটিল প্রযুক্তি ও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। এই প্রস্তুতির জন্য সময় কত লাগবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইরান বর্তমানে দুইটি কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা ওয়েপেন-গ্রেড (৯০ শতাংশ) এর কাছাকাছি। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এই মাত্রার ইউরেনিয়াম আরও সমৃদ্ধ করলে ইরানের কাছে ছয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো উপাদান থাকতে পারে।
নাতানজ: ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু
তেহরানের দক্ষিণে, কুম শহরের কাছে পাহাড়ঘেরা সমতলে অবস্থিত এই স্থাপনাটি দুটি প্রধান ইউনিট নিয়ে গঠিত—ভূগর্ভস্থ ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট (এফইপি) ও ভূপৃষ্ঠের পাইলট ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট (পিএফইপি)।
২০০২ সালে নির্বাসিত এক ইরানি বিরোধীদল নাতানজের অস্তিত্ব ফাঁস করলে, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক উত্তেজনার সূচনা হয়, যা এখনও চলমান।
এফইপি বানানো হয় বাণিজ্যিক পর্যায়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জন্য, যেখানে ৫০ হাজার সেন্ট্রিফিউজ (ইউরেনিয়াম পরিশোধনযন্ত্র) বসানোর সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ১৬ হাজার সেন্ট্রিফিউজ বসানো রয়েছে, যার মধ্যে ১৩ হাজার সক্রিয়ভাবে ৫ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।

এই স্থাপনাটি মাটির প্রায় তিন তলা নিচে অবস্থিত। ফলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় এর কতটা ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
এর আগে ২০২১ সালে সেখানে বিস্ফোরণ ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার ঘটনা ঘটে, যা ইরান ইসরায়েলের হামলা বলে দাবি করে।
অন্যদিকে, নাতানজের পিএফইপি তুলনামূলক ছোট এবং সেখানে মাত্র কয়েকশ সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর মাধ্যমেই ইরান ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।
ফোরদো
ক্বোম শহরের উল্টো দিকে একটি পাহাড়ে নির্মিত ফরদো কেন্দ্রটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের একটি গোপন ও সুরক্ষিত স্থাপনা। এটি ভূমির নিচে থাকায় ইসরায়েলি হামলার মতো বাহ্যিক আঘাত থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত বলে মনে করা হয়।
২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী ফরদোতে সমৃদ্ধকরণ নিষিদ্ধ ছিল। তবে এখন সেখানে প্রায় ২ হাজার সেন্ট্রিফিউজ চালু রয়েছে, যার বেশিরভাগই উন্নত আইআর-৬ মডেল। এদের মধ্যে প্রায় ৩৫০টি যন্ত্র ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স প্রকাশ করে, ইরান বহু বছর ধরে ফরদো গোপনে নির্মাণ করেছে এবং তা আইএইএ-কে জানায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তখন মন্তব্য করেন, এই কেন্দ্রের আকার ও কাঠামো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ইসফাহান
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইসফাহানে অবস্থিত একটি বড় পরমাণু প্রযুক্তি কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করা হয়। এখানে রয়েছে ফুয়েল প্লেট ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট (এফপিএফপি) ও ইউরেনিয়াম কনভার্সন ফ্যাসিলিটি (ইউসিএফ), যেখানে ইউরেনিয়ামকে গ্যাসে রূপান্তর করে সেন্ট্রিফিউজে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়।

কূটনীতিকদের মতে, ইরান এখানে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামও সংরক্ষণ করে। পাশাপাশি রয়েছে ইউরেনিয়াম ধাতু তৈরির যন্ত্রপাতি, যা পারমাণবিক বোমার কেন্দ্রীয় অংশ তৈরির জন্য ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় উদ্বেগের বিষয়।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইসফাহানে সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রাংশ তৈরির নতুন সুবিধাও গড়ে তোলা হয়েছে, যেটিকে সংস্থাটি ২০২২ সালে 'নতুন স্থাপনা' হিসেবে চিহ্নিত করে।