জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মুখ ফসকে বললেন, ইসরায়েল ‘সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে’

জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডরোথি শে পরিষদে বক্তব্য দেওয়ার সময় মুখ ফসকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে 'মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস ও দুর্ভোগ ছড়িয়ে দেওয়ার' অভিযোগ করে বসেন। পরে অবশ্য তিনি নিজেই সেই বক্তব্য সংশোধন করেন—এ খবর জানিয়েছে আল জাজিরা।
বক্তব্যের পরবর্তী অংশে শে ইরানকে সংঘাতের জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, তেহরান যদি তার পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করার একটি চুক্তিতে সম্মত হতো, তবে এই সংঘাত এড়ানো যেত।
ইরানের জাতিসংঘ প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি অভিযোগ করেন, 'এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আগ্রাসনকে বৈধতা দিতে যেভাবে তথাকথিত পূর্বসতর্কতামূলক হামলা ও অস্তিত্ব সংকটের কথা বলছে, তা নিন্দনীয়।' তিনি ইসরায়েলকে এমন একটি দেশ হিসেবে বর্ণনা করেন, 'যেটি নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে এবং অন্য দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন করে'।
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, বক্তব্য চলাকালে ইরাভানি ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিশুদের ছবি দেখিয়েছেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন ইরানের বিরুদ্ধে 'ভিকটিম সাজার নাটক' করার অভিযোগ তোলেন। তিনি ইরাভানিকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আপনারা নিজেদের গণহত্যার এজেন্ডা থেকে রক্ষা পেতে কীভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চাওয়ার সাহস দেখান?'
এই বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও পাল্টাপাল্টি দোষারোপের ফলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এমন সময়েই সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইরান ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে চলমান আলোচনা কোনও অগ্রগতি ছাড়াই মুলতবি হয়। একইদিনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যতক্ষণ না ইসরায়েল বোমা হামলা বন্ধ করছে, ততক্ষণ 'গঠনমূলক আলোচনা' সম্ভব নয়।
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা লড়াই বন্ধ এবং কূটনৈতিক পথে সমাধানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মোটামুটি একমত হলেও শেষ পর্যন্ত সভাটি পরিণত হয় দায় চাপানো ও দোষারোপের মঞ্চে।
জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) ১২ জুন জানায়, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। গত ২০ বছরে এই প্রথম দেশটির বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব পাস করল সংস্থাটি।
আইএইএ জানায়, ইরান এখন উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। সংস্থাটি আরও জানায়, এখন পর্যন্ত যারা এত উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, তারা সবাই পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক। তবে তারা সরাসরি বলেনি যে ইরান বোমা তৈরি করছে।
রাশিয়ার প্রতিনিধি নেবেনজিয়া আইএইএর প্রতিবেদনকে 'পক্ষপাতদুষ্ট' ও 'ভিত্তিহীন' বলে মন্তব্য করেন। অন্যদিকে, চীনের প্রতিনিধি ফু কং কিছুটা নরম ভাষায় কথা বলেন। তিনি ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানান এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। তবে তিনি আইএইএ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ইরান এখনই পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করছে না, তবে চাইলে এক বছরের মধ্যে তা করতে পারে। শুক্রবার এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'তাহলে আমার গোয়েন্দা সংস্থা ভুল বলছে।'
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ইরান বহুদিন ধরেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কথা অস্বীকার করে আসছে, কিন্তু এখনো 'বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব' রয়েছে।
তিনি বলেন, 'এই আস্থার ঘাটতি দূর করার একমাত্র উপায় হলো কূটনৈতিক সমাধান। এর জন্য দরকার একটি বিশ্বাসযোগ্য, পূর্ণাঙ্গ ও যাচাইযোগ্য সমঝোতা, যেখানে আইএইএর পরিদর্শকদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত থাকবে।'
গুতেরেস ইসরায়েল ও ইরানকে সতর্ক করে বলেন, যুদ্ধ যেন আর না বাড়ে, তার আগে শান্তির সুযোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, 'আমরা কেবল সংকটের দিকে এগোচ্ছি না, আমরা সংকটের দিকে ছুটে যাচ্ছি।'
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইরানজুড়ে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ২২৪ জন নিহত এবং ২,৫০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। অপরদিকে, ড্যানি ড্যানন জানান, ইসরায়েলে ইরানের হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৯ জন নিহত এবং প্রায় ৯০০ জন আহত হয়েছেন। দুই দেশই জানিয়েছে, হতাহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।