ইরানের নতুন ‘হাজ কাসেম’ ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার ইসরায়েলের জন্য হতে পারে হুমকির কারণ

রোববার ইসরায়েলে হামলা চালাতে 'হাজ কাসেম' নামে নতুন একটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের দাবি জানিয়েছে ইরান। এই ক্ষেপণাস্ত্রটির নামকরণ করা হয়েছে আল-কুদস বাহিনীর কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির নামে, যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে হত্যা করেছিল।
ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সলিড প্রপেলেন্ট চালিত (দ্রুত শক্তি সম্পন্ন জ্বালানি) ক্ষেপণাস্ত্রটির রেঞ্জ ১৪০০ কিলোমিটার। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর (আইআইএসএস) গবেষণা সহযোগী ফাবিয়ান হিনৎস-এর মতে, এই সলিড প্রপেলেন্টের ব্যবহার হাজ কাসেম ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তরল জ্বালানি ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় 'একাধিক' সুবিধা দেয়।
হিনৎস বলেন, 'প্রথমত, এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার প্রক্রিয়াটা অনেক সহজ—আলাদা করে জ্বালানি ভরার দরকার নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'খুব অল্প সময়েই এটি ছোড়া যায়। বেশি লোকজনও লাগে না, কারণ কেউ জ্বালানি দিচ্ছে এমন কাজ এখানে নেই। জ্বালানি বা অক্সিডাইজার বহনকারী আলাদা যানও দরকার হয় না। সব মিলিয়ে এটা অনেক সহজ একটা ব্যবস্থা।'
হিনৎস হারেৎজ-কে বলেন, ইরান যে 'হাজ কাসেম' ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, তা দেখতে অনেকটাই আগের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মতো। এর কারণ, ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও রেভল্যুশনারি গার্ড (আইআরজিসি) একই সময়ে আলাদা ভাবে কাজ করে—তারা অনেক সময় একই রকম ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র তৈরি করে ফেলে।'
তিনি বলেন, 'ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ছোড়ার মতো নির্ভুল ও সলিড জ্বালানিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাজ দু'পক্ষই করছিল। আইআরজিসি বানিয়েছে খাইবার শেকান, আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তৈরি করেছে হাজ কাসেম ক্ষেপণাস্ত্র।'
গত শুক্রবার থেকে ইরান ইসরায়েলের দিকে প্রায় ৩০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এর আগে এপ্রিল ও অক্টোবরে আরও দুই দফায় প্রায় ৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল। ইরানের কাছে আরও কিছু পুরোনো ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যেগুলো ইসরায়েল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে 'ফাত্তাহ-১' নামের একটি উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র, যা ২০২৩ সালে প্রথম ব্যবহার করা হয়। ইরানের দাবি, এটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র।
যে ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি গতিতে (ম্যাক ৫ বা তার বেশি) উড়ে দীর্ঘ সময় ধরে বায়ুমণ্ডলের ভেতরে চলতে পারে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে পারে, তাকেই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বলা হয়। তবে গত অক্টোবরে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ইরানের কাছে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র নেই বলে তারা মনে করেন।
ইরানের 'ফাত্তাহ-১' ক্ষেপণাস্ত্র ৪৫০ কেজি ওজনের ওয়ারহেড বহন করতে পারে এবং এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ১,৫০০ কিলোমিটার।
ইরান অনেক বছর ধরেই উন্নত ও আরও নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টকম কমান্ডার জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি জানিয়েছিলেন, ইরানের কাছে তৎকালীন সময়ে ৩,০০০-এর বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত ছিল।
গত বৃহস্পতিবার ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ইরানের হাতে প্রায় ২,০০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
তিনি আরও বলেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এই সংখ্যা ৮,০০০-এ পৌঁছাতে পারে বলে ইসরায়েল আশঙ্কা করছে। এই আশঙ্কাই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ।
হাজ কাসেম ও ফাত্তাহ-১-এর বাইরে ইরানের কাছে আরও তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যেগুলো ইসরায়েল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
প্রথমটি হলো 'এমাদ'। এটি পুরোনো 'শাহাব-৩' ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি উন্নত সংস্করণ। এতে ৭৫০ কেজি ওজনের ওয়ারহেড রয়েছে। এটি 'টার্মিনাল গাইডেন্স' প্রযুক্তির মাধ্যমে মাঝপথে দিক বদলাতে পারে এবং বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পরও লক্ষ্যভেদ করতে পারে। হুতি বিদ্রোহীরা এই ধরনের কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে ছুড়েছে।
আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র হলো খাইবার শেকান, যা ইরানের সবচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর একটি। এটি আধা টন ওয়ারহেড বহন করতে পারে এবং এর রেঞ্জ ১,৪০০ কিলোমিটার। এটি হাইপারসনিক না হলেও, এটি খুব সহজে আকাশ প্রতিরক্ষা এড়িয়ে যেতে পারে এবং অনেক বেশি নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম।
হিনৎস মনে করেন, গত কয়েক দিনে ইরান 'রেজভান' নামের আরেক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, তাতে 'বুস্টার' ব্যবহার করা হয়েছে। বুস্টার হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রের ইঞ্জিনযুক্ত সেই অংশ, যা কিছু দূর যাওয়ার পর ওয়ারহেড থেকে আলাদা হয়ে যায়।
'রেজভান' ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে অনেকটা 'কিয়াম' ও হুতিদের ব্যবহৃত 'বুরকান'-এর মতো। হাজ কাসেম-এর মতো এরও রেঞ্জ ১,৪০০ কিলোমিটার, তবে এটি তরল জ্বালানিচালিত। ক্ষেপণাস্ত্রটির দৈর্ঘ্য ১২ মিটার, আর ইরানের দাবি, এটি ১০০ মিটার এলাকার সবকিছু ধ্বংস করতে পারে।
সব মিলিয়ে ইসরায়েলের দিকে ঠিক কোন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। একদিকে ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ চেনা কঠিন, অন্যদিকে একই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের অনেক সংস্করণ থাকায় বিভ্রান্তি আরও বাড়ে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের আলাদা নাম থাকলেও, বাস্তবে একটির সঙ্গে অন্যটির পার্থক্য খুব সামান্য।