ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর তেলের ট্যাংকার বাজারে অস্থিরতা, ভাড়ার ঊর্ধ্বগতি

ইরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার পর শুক্রবার বিশ্বে তেলের ট্যাংকার বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, এতে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটতে পারে।
মারেক্স গ্রুপ পিএলসি-র তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়ায় অপরিশোধিত তেল পরিবহনের ভবিষ্যৎ খরচ নিয়ে জুলাই মাসের ফরওয়ার্ড ফ্রেট চুক্তিতে প্রতি মেট্রিক টনে ১৫ শতাংশ দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৮৩ ডলারে।
শিপব্রোকার ও ট্যাংকার মালিকরা জানিয়েছেন, বাস্তবে চার্টার রেট আরও বেশি হয়েছে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত অনেক কোম্পানি তাদের জাহাজ ভাড়ায় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বিশ্বের অন্যতম বড় ট্যাংকার মালিক প্রতিষ্ঠান ফ্রন্টলাইন জানিয়েছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে জাহাজ ভাড়ায় দিতে এখন আরও বেশি সতর্ক।
শুক্রবার ভোরে ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে, যার মধ্যে পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাও রয়েছে। এই হামলা দুই শত্রু দেশের মধ্যে বিরোধকে আরও গভীর করে তোলে।
ইরান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ইসরায়েলকে 'খুব বড় মূল্য দিতে হবে'।
অয়েল ব্রোকারেজ লিমিটেডের বৈশ্বিক শিপিং গবেষণা প্রধান অনুপ সিংহ বলেন, 'এখনকার পরিস্থিতি ঝুঁকির প্রিমিয়াম তৈরি করছে—জাহাজ মালিকেরা গালফ অঞ্চলে স্বাভাবিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমে জাহাজ পাঠাতে দ্বিধায় থাকবেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা ফ্রেট রেটের জন্য বড় বিষয়।'
এই হামলার ফলে জ্বালানি ও শিপিং খাতে বড় এক শঙ্কা দেখা দিয়েছে, ইরান হয়তো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। বিশ্বের অনেক জ্বালানিবাহী জাহাজ এই পথের ওপর নির্ভরশীল।
যদিও দীর্ঘমেয়াদে হরমুজ প্রণালী বন্ধ রাখা ইরানের পক্ষে বাস্তবসম্মত নয়, তবু দেশটি প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাণিজ্যিক জাহাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে, যা আগে করেছেও। ফলে জাহাজ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে।
টোকিওভিত্তিক শিপিং কোম্পানি নিপ্পন ইউসেন, মিতসুই ওএসকে লাইনস ও কাওয়াসাকি কিসেন ইতিমধ্যে তাদের জাহাজগুলোকে সতর্কভাবে চলাচলের নির্দেশ দিয়েছে।
শুক্রবার এশিয়ার শেয়ারবাজারে কসকো শিপিং হোল্ডিংস ও চায়না মার্চেন্টস এনার্জি শিপিং-এর শেয়ার ৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ইউরোপে ফ্রন্টলাইন পিএলসি ওসলোতে প্রায় ৭.৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে, পরে আবার কিছুটা কমেছে।
ফ্রন্টলাইন-এর বহরের দায়িত্বে থাকা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী লার্স বারস্টাড বলেন, 'আমরা এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে চার্টারে জাহাজ দেওয়ার ব্যাপারে অনেক বেশি দ্বিধাগ্রস্ত।'
নৌবাহিনীর সতর্কতা:
এই হামলার আগেই যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনী সতর্ক করেছিল যে উত্তেজনা বাড়লে হরমুজ প্রণালীসহ গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটে শিপিং-এ প্রভাব পড়তে পারে।
সম্মিলিত সামুদ্রিক বাহিনীর অধীনস্থ তথ্য-ভিত্তিক সংস্থা 'জয়েন্ট মেরিটাইম ইনফরমেশন সেন্টার' (জেএমআইসি)- জানিয়েছে, হামলার জেরে সামুদ্রিক পরিবহনে ঝুঁকি বেড়েছে। মিসাইল ব্যবহারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না তারা।
জেএমআইসি বলেছে, কিছু জাহাজের নেভিগেশন ইলেকট্রনিক্স জ্যাম হচ্ছে, ফলে বিকল্প ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বারস্টাড জানান, অতীতেও উত্তেজনার সময় জাহাজগুলো 'ফ্লোটিলা' আকারে নৌবাহিনীর নিরাপত্তা নিয়ে হরমুজ পার হয়েছে। কিন্তু এটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল, ফলে ভাড়া বেড়ে যায়।
হরমুজ প্রণালী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত এবং এমনকি ইরানের তেলবাহী ট্যাংকারগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ। এই প্রণালী বন্ধ হলে বৈশ্বিক তেল সরবরাহে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বারস্টাড বলেন, এটি একটি চরম পদক্ষেপ, এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি [বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত] বজায় রাখার সম্ভাবনা কম।
ভিএলসিসি চলাচল:
বিশ্বের অন্যতম তেলবাহী ট্যাংকার 'ভিএলসিসি'র অন্তত ১০ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্য গালফে থাকে প্রায় সবসময়ই। প্রতিদিন গড়ে সংস্থাটির ২০টি ট্যাংকার হরমুজ দিয়ে চলাচল করে।
বারস্টাড বলেন, যুদ্ধ ঝুঁকির বীমা যেভাবে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করবে, তার ওপর বাজারের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে।
বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ জলসীমা চিহ্নিতকারী জয়েন্ট ওয়ার কমিটির সচিব নীল রবার্টস বলেন, 'সামুদ্রিক যান এই হামলার লক্ষ্যবস্তু নয়, তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেড়েছে।'
তিনি বলেন, বর্তমানে এটি একটি 'লিস্টেড এরিয়া', ফলে এখান দিয়ে চলাচলের সময় বীমাকারীদের আগেই জানাতে হয়।'
রবার্টস আরও বলেন, 'সামুদ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখন পর্যন্ত বিষয়টি পর্যবেক্ষণের পর্যায়ে রয়েছে।'
তবে এই ধরনের উত্তেজনা কখনো কখনো ট্যাংকার বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেও পারে।
তেলের দাম বেড়ে গেলে চাহিদা কমে যেতে পারে, আবার দীর্ঘ সময় মধ্যপ্রাচ্য থেকে কার্গো বন্ধ থাকলেও ক্ষতি হতে পারে।
তবু এই পরিস্থিতিতে অঞ্চলভিত্তিক নিরাপত্তা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হতে পারে বলে জানান ড্রুয়ারি মেরিটাইম সার্ভিসেসের পরিচালক জয়েন্দু কৃষ্ণ।
তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বৈশ্বিক ড্রাই-বাল্ক ট্রেডের ১০ শতাংশের বেশি আসে, ফলে বাল্ক ক্যারিয়ার রেটও বাড়তে পারে।
কৃষ্ণ বলেন, 'মধ্যপ্রাচ্য থেকে যাতায়াতে অতিরিক্ত যুদ্ধঝুঁকি প্রিমিয়াম হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'সরবরাহ চেইন পুনঃসামঞ্জস্যে সময় লাগবে।'